
১৮.০৫.২০২০। সোমবার
সকাল ৬.৫০
আজ অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। কেন কে জানে! সকাল সকাল যে কী করে এত গরম পড়ে! মনে হয়, মাঝখানে রাতটা আসেনি। সূর্য পাটে বসেনি কাল। গেলেও কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাপটি মেরে ছিল। সকাল হতেই একলাফে বেরিয়ে এসে আগুন ওগরাতে শুরু করেছে।
সকাল ৭.১৩
আবার অবাক করেছে অন্তরা! কাল রাতে বাড়ি ফিরে ফেসবুক চেক করতে করতে ওর টাইমলাইনে একটা সাদা–কালো ভিডিও আর তার সঙ্গে ওর গান দেখলাম। শুনলাম। পরিযায়ী শ্রমিকদের বিপন্নতা নিয়ে। খুব ভাল লাগল। গর্ব হল। আবার মনে হল, গুণী ছেলেমেয়েগুলো যখন আশেপাশে থাকে, তখন তাদের গেঁয়ো যোগী মনে হয়। অন্তরা যখন ‘এবেলা’য় আমার সঙ্গে কাজ করত, তখন এগুলো জানতামই না। ওকে বরাবর একজন হ্যাপি গো লাকি, ফান লাভিং আর বিন্দাস বাচ্চা বলে মনে হতো। ওইপর্যন্তই। সেই মেয়ের মধ্যে যে এই জিনিস থাকতে পারে, তখন একবারও মনে হয়নি। আসলে বাচ্চাটা বড় হয়ে গিয়েছে।
এই অন্তরাটাকে যেন ও ওর মতো করে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের সকলেরই স্ক্রিপ্ট কেউ না কেউ কোথাও একটা লেখে। সেই চিত্রনাট্যে অন্তরা বরাবরের হিরোইন হয়ে থাক।
বেলা ১১.১৫
আজ থেকে ‘নাইট কার্ফু’ জারি হওয়ার কথা। এটা কতটা এবং কীভাবে এনফোর্সড হয়, সেটা দেখার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকব। দেখতে চাইব, মানুষ কীভাবে এই আটবাঁধটায় সাড়া দেয়। কারণ, অধিকাংশ মানুষ তার ভিতরের বেসিক বিশৃঙ্খলায় বিশ্বাস করে। তার সঙ্গে বেশ খানিকটা অশিক্ষা। যারা এখনও বুঝতে পারছে না, যে একটা মারণ ভাইরাস সারা পৃথিবীকে নতজানু করে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছে এবং তার পাল্লায় পড়লে নিমেষে প্রাণটা বেরিয়ে যেতে পারে, তাদের এভাবেই তালাবন্দি করে রাখতে হয়।
সমস্যাটা হল, আমরা করোনার চেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি লকডাউনকে! লকডাউনের মেয়াদ আরও ১৪ দিন বেড়েছে শুনে চারপাশে যে সমবেত দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুরু করেছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় আমপানকে কিন্ডারগার্টেনে শিশু মনে হচ্ছে। লোকে বলবে প্যারানইয়া। আতঙ্কগ্রস্ততা। তাদের বলে বোঝানো যাবে না, এখন আতঙ্কটাই প্রয়োজন। খালিহাতে যারা বাঘ মারতে যায়, তারা বীর নয়। আকাট মূর্খ। গর্ধভ।
দেখা যাক, আগামী ১৪ দিন কীভাবে যায়। পাশাপাশি এটাও দেখতে চাই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই নাইট কার্ফু বলবৎ করে কিনা।
দুপুর ১২.৩৯
আবার নর্মাল রুটিনে ফেরত গেলাম। ৪৫ মিনিট ওয়ার্কআউট। গরমের চোটে এসি চালিয়ে ওয়ার্কআউট করব বলে একবার ভেবেছিলাম। কিন্তু মধ্যবিত্ত বিবেক বড় ভীরু। বড় নাচার। তার মনে পড়ে গেল, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ ইত্যাদি। অতএব ভ্যাপসা গরমেই কসরত করে ঘামে চপচপে টি–শার্ট গায়ে এই এন্ট্রি লিখলাম।
দুপুর ১.৩৩
আজ দুপুরের মেনু ডাল–ভাত–আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ। রাজা মেনু। এই বয়সে নাকি বেশি ডিম খাওয়া বারণ। কিন্তু এক–দুদিন খেলে কি আর কোলেস্টেরল লাঠি নিয়ে তাড়া করবে?
চিরকাল মাছ খাওয়ায় আপত্তি। ছোটবেলায় বড়মামু হাতে লাঠি নিয়ে বসে থাকত আর আমার হাঁ–মুখে মাছেভাতের গ্রাস ঠুসে দেওয়া হতো। সেই অত্যাচারে চোখ থেকে জলও গড়িয়ে পড়ত বলে জনশ্রুতি। একটু লায়েক হওয়ার পর জীবন থেকে মাছ বাদ দিয়ে দিলাম। লোকে শুনলে মারতে আসবে যে, ইলিশ মাছ খেতে ভাল লাগে না। একটাই কারণ— কাঁটা। ওই সরু সরু কাঁটা–ফাটা ছাড়িয়ে মাছ খাওয়া খুব বোরিং। অনেকে কাঁটাও চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। আমি পারি না। বেড়াল তো নই। তবে কেউ মাছ বেছে দিলে ঠিক আছে। ফলে মাছ বলতে আমার কাছে ভেটকি, আড়, পমফ্রেট বা চিংড়ি। অথবা লম্বা লম্বা তলোয়ারের মতো কাঁটাওয়ালা কাতলামাছের টুকরো। যাকে নরেন্দ্রপুরে ফ্ল্যাট পেটি বলে ডাকা হতো। হস্টেলে ডিম থাকলে খুব আনন্দ হতো। কারণ, থালা ধুতে কোনও চাপ নেই। পাতে কোনও বাড়তি এবং ফালতু জঞ্জাল নেই। এমনকী, চাইলে চেটেও থালা সাফ করে ফেলা যায়।
আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে, ডিম কেন আমার সবচেয়ে প্রিয়?
ডিমে কাঁটা নেই!
দুপুর ২.০০
আজ সকালে মিঠু ওর টাইমলাইনে ক্রিকেটব্যাট কাঁধে ওর একটা ছোটবেলার ছবি দিয়েছে। সাদা–কালো। তার তলায় রাজা লিখেছে, ‘বন্ধু চল।’
পোস্টটা দেখে একদৌড়ে ৩০ বছর আগে চলে গেলাম। ক্রিকেট খেলে বড় হওয়ার স্বপ্ন আর গাব্দা কিটব্যাগ কাঁধে করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খেলতে যাওয়ার দিনগুলোয়। অফিসটাইমে ভিড় বাসে সেই ব্যাগের গুঁতো খেয়ে নিত্যযাত্রীদের গঞ্জনা। নিরীহ মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর দু’দিনের ম্যাচ। সারা বছর বেলেঘাটা লেকের মাঠে কোচিং নিতে যাওয়া। উদয়াস্ত পরিশ্রম। সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা। বুস্টার লাগিয়ে ঝিরঝিরে টিভি স্ক্রিনে বাংলাদেশ ধরে চ্যানেল নাইনে খেলা দেখা এবং শেষমেশ অসমসাহসী হয়ে স্রেফ ডোনেশনের উপর ভর করে পাড়াতেই একটা কংক্রিটের উইকেট বানিয়ে ফেলা।
মধ্যবিত্ত সংসারে কষ্ট করে কেনা ইংলিশ উইলো। তাতে তার্পিন তেল মাখিয়ে সজুত করা। রাতে বালিশের পাশে নিয়ে নতুন ব্যাটের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘু্মিয়ে পড়া। রোজ স্বপ্ন দেখা যে, চকচকে লাল বল কংক্রিট উইকেটের উপরের ম্যাটে পড়ে আরও দ্রুত ছুটে আসছে। আর কখনও সামনের পায়ে, কখনও ব্যাকফুটে গিয়ে কপিবুক ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করছি।
নেটে ব্যাট করতে গিয়ে রাউন্ডের শেষে মনে মনে কল্পিত ফিল্ডিং সাজিয়ে জেতার রান তোলার চেষ্টা করতাম। কখনও মিঠু নেটের ভিতরে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে দুঃসাহসিক কিপিং করত। ক্রিজ ছেড়ে বেরোলেই চোখের পলকে উইকেট ভেঙে দেবে। কখনও রাজা আম্পায়ারের জায়গায় দাঁড়িয়ে বলত, ‘থ্রি ডেলিভারিজ টু গো। টেন রান্স টু গেট। জিতে দেখা!’ কখনও বাপ্পা ছোট রান আপে এসে বাতাসে ভাসিয়ে ছোট ছোট আউটসুয়িং করাত। আবার একই অ্যাকশনে এসে শেষমুহূর্তে কাঁধের জোরে একটা অফ কাটার মারত।
ব্যাট স্পিডের সঙ্গে ছুটে আসা লাল বলের একটা আত্মীয়তা আছে। ব্যাটের সুইট স্পটে বলটা ধাক্কা খেলে ‘টকাস’ করে একটা স্বর্গীয় আওয়াজ হয়। সেই আওয়াজটা শোনার জন্য ইডেনে কতবার খেলা শুরুর একঘন্টা আগে পৌঁছে গিয়েছি! যাতে নেটটা দেখতে পারি। আর ওই আওয়াজটা ফাঁকায় ফাঁকায় কানে আসে।
স্কোয়্যার অফ দ্য উইকেটে স্ট্রং ছিলাম। আর ‘ভি’–এর মধ্যে খেলতে। মশারির মতো নেটে স্কোয়ার কাট, কভার ড্রাইভ বা ফ্লিক কতদূর গেল বোঝা যেত না। কখনও সখনও একেকটা স্ট্রেট ড্রাইভ গুলির মতো ছুটত বোলিং উইকেটের পাশ ঘেঁষে। সবুজ ঘাস ফালা ফালা হয়ে যেত বলের সিমে। ফলো থ্রুতে স্ট্রোকটা ফিনিশ করে যতক্ষণ দেখা যায়, তাকিয়ে থাকতাম।
ছোটবেলার ইনজামাম উল হকের মতো দেখতে মিঠুর ব্যাটিংয়ে একটা অলস সৌন্দর্য ছিল। কালেভদ্রে বোলিং করত। করলে লাইনে লাইনে। বাপ্পা মূলত বোলার ছিল। কিন্তু ব্যাটটাও দারুণ করত। রাজা ওয়াজ আ ডেড সিরিয়াস ব্যাট। ফিল্ডিংয়ে প্রচণ্ড জোর দিতাম। ফিল্ডিং নিয়ে প্রচণ্ড খাটতাম। আসলে আমরা ফিল্ডিং করতে ভালবাসতাম। পৃথিবীটা ছিল একটা অতিকায় স্কোরবোর্ডের মতো। সেখানে রোজ নিজেদের রান বাড়ানোর চেষ্টা করে যেতাম।
দোজ ওয়্যার দ্য ডেজ মাই ফ্রেন্ড। আই থট দে উড নেভার এন্ড!
দুপুর ২.২৩
আজ বেসরকারি বাস পথে নামেনি। হলুদ ট্যাক্সির অবস্থাও নাকি তথৈবচ। অন্তত টিভি তেমনই বলছে। আরও বলছে, সরকারি বাসও নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। রাস্তায় বেদম ভিড়। এই অবস্থাটা কাম্য ছিল না। একেবারেই কাম্য ছিল না।
বিকেল ৪.১০
কেন্দ্যীর সরকারের নির্দেশিকা মেনেই পশ্চিমবঙ্গে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত লকডাউন থাকবে। নবান্নে জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তবে ঘোষিত নাইট কার্ফু নয়। যেমন মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমরা অফিশিয়ালি কার্ফু বলবৎ করছি না। কার্ফু শব্দটা ভাল নয়। দাঙ্গা–টাঙ্গা হলে বা ওইধরনের কোনও গুরুতর পরিস্থিতি তৈরি হলে কার্ফু জারি করা হয়। এটাও অবশ্য গুরুতর পরিস্থিতি। কিন্তু আমরা কার্ফু শব্দটা ব্যবহার করছি না। মানুষকে দমবন্ধ করে টেনশনে ফেলা উচিত নয়। আপনারা লকডাউন মেনে চলবেন। রাস্তায় গ্যাদারিং হলে কিন্তু পুলিশ অ্যাকশন নেবে।’
পাশাপাশিই মুখ্যমন্ত্রী জানাচ্ছেন, ২১ মে থেকে আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস চালু হবে। চালু হবে অটোও। অটো চালানোর আগে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। কনটেনমেন্ট জোনের বাইরে সব বড় দোকান খুলবে ওইদিন। দোকানে মাস্ক এবং গ্লাভস বাধ্যতামূলক। স্যানিটাইজারও রাখতে হবে। খুলবে সেলুন, পার্লার ইত্যাদিও। সামাজিক দূরত্ব মেনে খোলা হবে হোটেল। তবে রেস্তোঁরা এখনই খুলছে না।
২৭ মে খুলবে হকার্স মার্কেট। জোড়–বিজোড় নীতি মেনে হকার্স মার্কেট খুলতে পাস দেবে পুলিশ। সর্বত্র মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার রাখতে হবে। যেখানে যেখানে সম্ভব, সেখানে খেলাও শুরু হবে। প্রাথমিকভাবে ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল স্পোর্ট। কিন্তু কোনও দর্শক থাকবে না।
করোনাভাইরাসের প্রকোপের নিরিখে বিভিন্ন এলাকাকে এ, বি এবং সি জোনে ভাগ করা হবে।
‘এ’— অ্যাফেক্টেড জোন
‘বি’— বাফার জোন
‘সি’— ক্লিন জোন
বিকেল ৪.২২
সুপার সাইক্লোন আমপান নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেখানে সমস্ত রাজ্যের প্রতিনিধিকে ডাকা হয়েছিল। ওই বৈঠক নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, রাজ্যের মুখ্যসচিব বা স্বরাষ্ট্রসচিবকে ওই বৈঠকের বিষয়ে কিছু জানায়নি দিল্লি। অবহিত করেনি মুখ্যমন্ত্রীকেও। তার বদলে দিল্লিতে নিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনারকে ডেকেছিল বৈঠকে।
পশ্চিমবঙ্গের কুপিত মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘রেসিডেন্ট কমিশনারকে ডেকে ব্রিফ করেছেন হোম মিনিস্টার। এটা অসৌজন্য। এটাকে অসাংবিধানিক বলব কিনা জানি না। কিন্তু ওঁরা আমাদের কাউকেই কিছু জানাননি। রেসিডেন্ট কমিশনার তো আর ব্যাপারটা সামলাবে না। কাজটা তো করছে রাজ্য সরকার। তো তাদেরই কিছু জানানো হল না? এই ব্যাপারটা আমাকে ভাল করে দেখতে হবে।’
সন্ধ্যা ৭.৪৪
আমপান যেভাবে শক্তিবৃদ্ধি করছে, মনে হচ্ছে সাময়িকভাবে করোনাকে পিছনে ফেলে দেবে। টিভি–তে ঘনঘন আপডেট, হাওয়া অফিসের কর্তার বাইট এবং তার সঙ্গে স্যাটেলাইটে ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থান নিয়ে নিরন্তর চর্চা। অফিসে সহকর্মীদের কাছে যা শুনছি, এর কাছে আয়লা–টায়লা নাকি একেবারে বাচ্চা। ঝড়ের গতিবেগ হতে পারে ঘন্টায় ১৮০ কিলোমিটার। ইতিমধ্যেই উপকূলে সতর্কতা জারি হয়েছে। হ্যান্ডমাইক নিয়ে ধাতব গলায় প্রশাসনিক আধিকারিকরা লোকজনকে সতর্ক করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে বাসিন্দাদের তুলে এনে রাখা হবে কোথায়? কোনও স্কুল বা কলেজের বাড়িতে রাখলে সেখানে তো আবার সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানা যাবে না। বাড়িতে থাকলে আমপানে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শেল্টারে থাকলে করোনায় ধরবে। এই উভয়সঙ্কটে লোকগুলোর যে কী হবে! তবে মাটির মানুষদের সহ্যশক্তি প্রবাদপ্রতিম। তাঁরা ঠিক বেঁচে থাকবেন এবং টুকটুক করে ভাঙা জীবনের অংশগুলো কুড়িয়ে আবার জোড়া দিয়ে নেবেন।
ঘূর্ণিঝড়ের কথা উঠলেই ‘সিডার’–এর কথা মনে পড়ে। সাধারণত, প্রতিটা ঘূর্ণিঝড়ই এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলা কোলে টেনে নেয়। সেবারও তা–ই হয়েছিল। বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কয়েক হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। কলকাতা থেকে কভার করতে গিয়েছিলাম। তখন ঋতব্রত ভট্টাচার্য কাজ করত তৎকালীন স্টার আনন্দে। ও–ও জুড়ে গেল আমার সঙ্গে।
ঢাকায় একদিন কাটিয়ে পরদিন বিশাল পদ্মা পেরিয়ে বরিশালে গেলাম। জেটি থেকে ডেক পর্যন্ত পাতা পাটাতন পেরিয়ে স্টিমারে পরপর যাত্রী–সহ গাড়ি উঠে গেল। আমরাও সেভাবেই গেলাম। এমন অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি। পদ্মা পেরনোর সময় উপরের ডেকে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ করলাম। দারুণ মানুষ। এবং বাকি বাংলাদেশিদের মতোই অসম্ভব অতিথিবৎসল। চলন্ত স্টিমার থেকেই জাল ফেলিয়ে মাছ তোলালেন। ওপারে পৌঁছতে পৌঁছতে সেই মাছ কাটিয়ে, ভাজিয়ে খাইয়েও দিলেন।
বরিশালে নেমেই মা’কে ফোন করলাম। মা প্রবল উত্তেজিত গলায় গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘অমুক পাড়ার তমুক বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করিস। ওখানে একটা কাঠচাঁপার গাছ ছিল। সেটা আছে কিনা একটু দেখিস তো! বড়মামুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা কর। তোকে ঠিকঠাক বলে দিতে পারবে।’
আবেগতাড়িত মায়ের সিডার কোনওক্রমে থামিয়ে বললাম, অ্যাসাইনমেন্টে এসেছি। মাতামহের ভিটে এবং তার আঙিনায় কাঠচাঁপা গাছের খোঁজে নয়।
দিনতিনেক ছিলাম বরিশালে। সত্যিই ‘আইতে শাল, যাইতে শাল’। সাঁতার জানতাম না। এখনও জানি না। পড়ে গেলে স্রেফ একটা ঢিলের মতো ডুবে যেতাম। কিন্তু রোজ নৌকা করেই ঘুরতাম। কোথাও নদী, কোথাও খাল, কোথাও খাঁড়ি। দেখতাম, কী অবর্ণনীয় কষ্ট মানুষের। ঘূর্ণিঝড় তাঁদের প্রান্তিক সংসার ওলটপালট করে দিয়ে গিয়েছে। রাস্তায় বসে আছেন মাথায় হাত দিয়ে। তাঁদের ভাষায় কথা–বলা ভিনদেশি সাংবাদিক দেখে আঁকড়ে ধরে কষ্টের কথা বলতেন। তাঁদের পাশেই ভেঙেচুরে যাওয়া রাস্তার উপর কাঠের উনুন জ্বালিয়ে ভাত রান্না হতো। আতুর মানুষের গায়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে। ভাতের সুবাস আর সেই ক্লিন্ন গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।
আমপান নিয়ে যে পরিমাণ উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে সেই মানুষগুলো আবার জলে পড়বেন।
রাত ১০.৩১
চার নম্বর লকডাউনের প্রথমদিন কেটে গেল। ডায়েরি বন্ধ করার আগে চোখ বুজলে শুনতে পাচ্ছি ব্যাটের সুইট স্পটের ‘টকাস’ শব্দটা। সবুজ ঘাস চিরে বাউন্ডারির দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে চকচকে নতুন বল। লকডাউনের পৃথিবীর স্কোরবোর্ডে আরও কিছু ধৈর্যের রান জুড়ল।
চকচকে নতুন বলটা এক ছুটে বাউন্ডারি ছুঁয়ে তছনছ করে দিক সব ব্যবধান। ঘুচিয়ে
দিক সব নিষেধ।
এমন কেন সত্যি হয় না আহা!
LikeLike
অসাধারণ দিনলিপি👌👌
LikeLike
Dhobyobad 🙂
LikeLike
আমার বয়স যদিও এখনো খুবই কম,সবে ২০, কিন্তু আপনি যে ক্রিকেট খেলার স্বপ্নের কথা বললেন,সেটার সাথে ভীষণ একাত্ম বোধ করলাম…অনেক আগের কথা মনে পড়ে গেল… নতুন ব্যাটের উপর সেই অদ্ভূত টান টার কথা খুব পরিষ্কার ভাবে মনে পড়ে গেল।আমিও যে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখেছিলাম!
LikeLike