
১৫.০৫.২০২০। শুক্রবার
সকাল ৭.৩০
কাল বেশি রাতে মানস’দা ফোন করেছিল। দেবেশ রায় চলে গিয়েছেন। তার খানিক আগে ফেসবুকে বাংলাদেশের এক বন্ধুর পোস্ট দেখেছিলাম— আনিসুজ্জামান প্রয়াত।
ইদনীং কেউ চলে গেলে প্রথমেই ধক করে একটা প্রশ্ন এসে বুকে লাগে— কোভিড নয় তো?
ওপার বাংলার বন্ধুর পোস্ট বলছিল, আনিসুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ওই ধরনের কোনও প্রতিষ্ঠানে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া যাবে না। কোভিড প্রটোকল অনুযায়ী তাঁর দেহ দাফন করা হবে। আর আজ সকালে পরিচিতরা বলল, দেবেশবাবুকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাগুইআটির নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়েছিল। ফলে প্রয়াণের পর তাঁরও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেটি কোভিড পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। টেস্ট রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত তাঁরও অন্ত্যেষ্টি থমকে থাকবে।
কী আশ্চর্য!
শোনা ইস্তক বারবার মনে হচ্ছে, এই লকডাউনের সময় যাঁরা চিরকালের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, সেইসব গুণী মানুষের শেষযাত্রাটা অপ্রত্যাশিতভাবে সাদামাটা হয়ে থাকল।
পিকে ব্যানার্জি, ঊষা গাঙ্গুলি, চুনী গোস্বামী, ইরফান খান, ঋষি কাপুর। তারপর দেবেশবাবু। সকলেই কেমন অন্তরালবর্তী হয়ে বিদায় নিলেন। কোথাও কোনও গণশ্রদ্ধাজ্ঞাপন হল না। মরদেহে মালা দিতে পারলেন না গুণমুগ্ধরা। পা ছুঁয়ে প্রণাম জানাতে পারলেন না শেষবারের মতো। পিকে–র প্রয়াণের সময় তা–ও পরিস্থিতি খানিকটা কম গন্ডগোলের ছিল। কিন্তু চুনী? ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নক্ষত্র। তাঁর প্রয়াণ এবং প্রস্থান হল প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। যোধপুর পার্কের নার্সিংহোমে দেহান্ত। তারপর পাশেই বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা। ‘আজকাল’–এর খেলার পাতায় ‘তর্পণ’ সিরিজে সুভাষ ভৌমিক বলেছেন, ‘চুনীদা জীবনে যা চেয়েছেন, সব পেয়েছেন। ছেলেকে বলেছিলেন, তাঁর মৃতদেহ যেন কোথাও ঘোরানো না হয়। শ্মশান ছাড়া মাটিতে না নামানো হয়। সেই শেষ ইচ্ছেটাও পূর্ণ হয়েছে।’
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আজীবন গ্ল্যামার ধরে রাখা চুনী যে চাইবেন না তাঁর মরদেহ মাটিতে নামানো হোক, সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই এটাও চাননি যে, তাঁর শেষযাত্রা হোক মুখে মাস্ক পরিহিত এবং কার্যত জনমানবহীন পটভূমিতে!
বারবার মনে হয়, মৃত্যুর পর তাঁদের স্মৃতিতর্পণের জন্য কী করা হচ্ছে, মৃতেরা তা জানতেও পারেন না। কিন্তু মনে হয়, কৃতী বা সাধারণ— যেমনই হোন, মৃত্যুকে সবসময় সেলিব্রেট করা উচিত। মরজগৎ থেকে আত্মার মুক্তির সেলিব্রেশন। মৃত্যু তো আসলে একটা মুক্তিই। লিবারেশন।
সকাল ৮.২৩
কেন জানি না দেবেশবাবুর খুব বেশি লেখা পড়িনি। এমনিতে যে আমি খুব পড়ুয়া, তা নয়। টুকটাক পড়ি এইমাত্র। কিন্তু দেবেশবাবুর লেখা সেভাবেও পড়া হয়ে ওঠেনি। খানিকটা লজ্জার সঙ্গেই লিখছি, তাঁর ‘যযাতি’ বা ‘মানুষ খুন করে কেন’ তো দূরস্থান, তাঁর অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ও খুব খুঁটিয়ে পড়েছি, তা নয়। বরং ওই উপন্যাস নিয়ে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নাটকটা বেশি মন দিয়ে দেখেছিলাম। মনে হয়, দেবেশবাবুর ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শই তাঁকে এই অধম পাঠকের কাছে লেখক হিসেবে নিজেকে উন্মুক্ত করতে দেয়নি। সেটা পাঠকেরই খামতি। সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় নিজেকে একেবারে আন্দোলনের বিপরীত সারিতে রেখেছিলেন। সেটাও তাঁর থেকে পাঠক হিসেবে দূরত্ব রচনার একটা কারণ হয়ে থাকবে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে বাম বা অবাম— কোনও রাজনীতিতেই আমার বিশ্বাস নেই। হবে বলেও মনে হয় না। কারণ, পুরোটাই তামাশা বলে মনে হয়।
দেবেশবাবুর সঙ্গে প্রথম এবং শেষ দেখা গতবছরের ২২ নভেম্বর রোটারি সদনে। ‘মতি নন্দী পুরস্কার’ অনুষ্ঠানের মঞ্চে। ঘটনাচক্রে, তিনি এবং জয় গোস্বামী প্রাপকদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন। এবং ঘটনাচক্রে, দুই প্রাপকের মধ্যে একজন ছিলেন বাংলাদেশের সেলিনা হোসেন। অন্যজন এই হীনম্নন্য।
পুরস্কার অর্পণের আগে দেবেশবাবু একটি সুদীর্ঘ বক্তৃতা করেছিলেন। সেদিন কলকাতায় ভারত–বাংলাদেশ গোলাপি বল নিয়ে দিনরাতের ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়েছে। গোটা শহর সেই মোচ্ছবে। ফলে রোটারি সদন কার্যত ফাঁকা। শ্রোতার আসনে তেমন কেউ নেই। মঞ্চে বসা মন্ত্রীও উসখুস করছেন। তাঁকে আবার ইডেনে ফিরতে হবে। কিন্তু দেবেশবাবু পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। অন্তত সাতপাতার একটি ভাষণ লিখে এনেছিলেন। ধীরেসুস্থে পাতা উল্টে উল্টে পুরোটা শেষ করলেন। তারপর আসনে ফিরতে ফিরতে বললেন, ‘আরও একটু বলতে পারতাম। কিন্তু সময় কম।’
বলার যেটা, ওই ভাষণে তিনি আমার সম্পর্কে এমন তথ্য দিয়েছিলেন, যা আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম। আমি নাকি আনন্দবাজারে কাজ করাকালীন একদিন রাত দুটোর সময় তাঁকে ফোন করে কোনও একটি ফার্সী শব্দের বঙ্গানুবাদ জানতে চেয়েছিলাম। হতে পারে। না–ও পারে। কিন্তু সেদিন তিনি ওই কথাটা বলার পর পুরস্কারের অভিজ্ঞানটি নিয়ে এবং তার সঙ্গে দাতব্য ৫০ হাজার টাকার নগদনারায়ণ বা সম্মানদক্ষিণাটি উদ্যোক্তাদের ফিরিয়ে দিয়ে আসা পর্যন্ত মাথা খুঁড়েও স্মৃতিতে তেমন কোনও ঘটনা খুঁজে পাইনি। হয়তো সত্যিই ভুলে গিয়েছি।
দেবেশবাবু সম্পর্কে ওই সন্ধ্যাটিই আমার একমাত্র স্মৃতি। তাঁর প্রয়াণে ফেসবুক ইত্যাদি জুড়ে যখন শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ঢল নেমেছে, তখন কি এই স্মৃতির কথা না লিখলেও চলত? কে জানে! কিন্তু এই ডায়েরি তো আটবাঁধ রহিত সমকালের দলিল। না হয় সেখানে তার অনায়াস পদচারণা রইলই।
সকাল ৯.২৭
বরাবর মনে হয়, এই শোকের ছায়াটা নামে কীভাবে? কোথায় নামে? কোথা থেকে নামে? এই ছায়াটা কি গ্রহণের মতো? চারদিকটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়? তারপর আবার গ্রহণ ছাড়ে। তখন আবার ছায়া সরে যায়। তেমন?
বা শোকস্তব্ধ। তখন কী হয়? সকলে কি বোবা হয়ে যায়? কেউ কোনও কথা বলতে পারে না? মুখ চাপা দিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে? নাকি কাঁদতেও পারে না? স্রেফ স্ট্যাচু হয়ে যায়? স্তব্ধতাটা কতক্ষণ বা কতদিন থাকে? মরদেহ সৎকার হওয়া পর্যন্ত? নাকি স্মরণসভা বা শোকসভা হওয়া পর্যন্ত?
এই কথাগুলো মাঝেমাঝেই মনে হয়। কাউকে বলতে পারি না। যদি ভাবে, রসিকতা করছি। কিন্তু সিরিয়াসলিই মনে হয়। মনে হয়, শোকের আয়ু কতদিন? কত ঘন্টা?
বেলা ১১.৪৮
এবার শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন নিয়ে কেন্দ্র–রাজ্য লেগে গেল!
গতকাল মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে জানিয়েছিলেন, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আটক বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য মোট ১০৫টি ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়ে দেন, রাজ্য সরকার ১০৫টি ট্রেনের কথা বলেছে আগামী একমাসের জন্য অর্থাৎ, ১৫ জুন পর্যন্ত। তা–ও সেগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য রেলকে দেওয়া হয়নি। গোয়েলের বক্তব্য, ‘আমরা চাইলে দিনে ১০৫টা করে ট্রেন দিতে পারি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ৭টা ট্রেন ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। আমরা চাই, বাংলার যেসব শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্যে আটকে আছেন, তাঁরা যথাসম্ভব দ্রুত বাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু রাজ্য সরকারের সেই সদিচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে না।’
একই দাবি গতকাল করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তিনিও বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৭টার বেশি ট্রেন ঢোকার অনুমতি দেয়নি। সেখানে উত্তরপ্রদেশ প্রায় ৪০০টি, বিহার ২০০টিরও বেশি ট্রেন ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ঝাড়খন্ড, রাজস্থান এবং ছত্তীশগড় প্রশাসন সম্পর্কেও একই বক্তব্য কেন্দ্রীয় সরকার তথা রেলমন্ত্রকের। যে, এই রাজ্যগুলির কোনও সদিচ্ছাই নেই তাঁদের রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজেদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
ঘটনাচক্রে, এই চারটি রাজ্যই আপাতত অ–বিজেপি শাসিত। ফলে এই বাগ্বিতন্ডা রাজনৈতিক। যা আবার নতুন করে শুরু হল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রেশন নিয়ে গোলমালের পর আবার একটা নতুন ফ্রন্ট খুলল যুদ্ধের। বা বলা ভাল, রাজ্যপাল আবার টুইট করার মশলা পেলেন।
দুপুর ১২.০৯
গরমে একটু বেশিই কাহিল হয়ে পড়েছি। গত কয়েকদিন ধরে আন্দামানের দিকে তাকিয়ে আছি। সেখান থেকে নাকি বিশাল ঘূর্ণিঝড় আসবে। কবে আসবে কে জানে!
কালবৈশাখিও আর আসে না। রাস্তা ভুলে গিয়েছে বোধহয়। বেডরুমটা এখন একটা গর্তের মতো লাগে। মনে হয়, সারাদিন এই গর্তেই থাকি। বাইরে বেরোলেই গরমের চোটে দম আটকে আসে। ট্যাপ খুললে আগুনের মতো গরম জল পড়ে। স্নান করেও শান্তি মেলে না। গা মোছা মাত্র কপাল ঘেমে যায়। কানের পিছন দিয়ে তিরতির করে ঘাম নামতে থাকে। এই গেরো থেকে বোধহয় জীবনে আর মুক্তি নেই। বিভিন্ন জেলায় শিল পড়ছে আর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে শুনলে আরও গা জ্বালা করে।
আজ ইচ্ছে করেই ওয়ার্কআউটে বিরতি দিলাম। শরীরে দিচ্ছে না। এমনিতেও সাতদিনে একদিন বিরতি দেওয়া বা বিশ্রাম নেওয়া ভাল। এটাই নিজেকে নিজে আজ বোঝালাম।
দুপুর ১.০৫
বরফজলে স্নান করেছি। একটু বেটার লাগছে। যতদিন না এই কুৎসিত গরমটা যাচ্ছে, ততদিন দুপুরে বরফজলেই স্নান করব। আর ব্যক্তিগত ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্প শুরু করব। অর্থাৎ, অফিসে বেরোনর আগে বালতিতে জল ধরে জল ভরে রেখে যাব। রাতে বাড়ি ফিরে সেটায় স্নান করব।
দুপুর ১.২৫
শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম। তখনই আবার মনে হল পাবলিক স্পিকিংয়ের কথা। মনে হল, আমরা বড় বেশি কথা বলি। বক্তৃতা? হচ্ছে তো হচ্ছেই। সাংবাদিক বৈঠক? চলছে তো চলছেই। গুচ্ছের আজেবাজে বকা। যার কোনও প্রয়োজন নেই। কাজের কথাটা বলে দিলেই হয়। কিন্তু সেটা হয় না। সাধে কি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর দেশ জুড়ে মিম তৈরি হয় এই মর্মে যে, কী বলতে চাইছো? অর্থাৎ, বকলাম প্রচুর। কিন্তু কাজের কথা কিছু বললাম না।
আরও মনে হল, মঞ্চ এবং মাইক্রোফোন কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার একটা গাইডলাইন বা ম্যানুয়্যাল সর্বত্র থাকা উচিত। বহু বছর আগে কলকাতার এক শিল্পোদ্যোগী এক অনুষ্ঠানের মঞ্চে ভরা স্টেডিয়ামে অমিতাভ বচ্চনের হাত ধরে টানতে টানতে বলেছিলেন, ‘তুমি বাংলার জামাই। কচি করে কিছু দিয়ে যাও গুরু!’ তখনই মনে হয়েছিল, এটার একটা প্রোটোকল থাকা উচিত। কোথায় কী বলা উচিত এবং উচিত নয়। বা বললেও কতক্ষণ বলা উচিত।
নিজে যখনই পাবলিকলি কিছু বলেছি, সময় বা বিষয়ের পরিসরের বাইরে যাইনি। আইসিসিআরে সুমিত’দার স্মরণসভায় সময় ছিল বক্তা প্রতি পাঁচমিনিট। যতদূর মনে পড়ছে, প্রত্যেকেই সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছিলেন। পাঁচ তো দূরের কথা, অনেকে ১০ এমনকী, ১৫ মিনিটও নিয়েছিলেন। উইংসে দাঁড়িয়ে সঞ্চালক ডেরেক ও’ব্রায়েন মাথা চাপড়াচ্ছিল। আমি ছিলাম সকলের শেষে। রিস্টওয়াচটা পোডিয়ামে চোখের সামনে রেখে ৪ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে শেষ করেছিলাম। ডেরেক হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। স্মরণসভার পর বলেছিল, ‘ইউ আর দ্য ওনলি ডিসিপ্লিন্ড ওয়ান। শর্ট, টু দ্য পয়েন্ট অ্যান্ড দ্য বেস্ট!’
বাঙালি এমনিতেই মাইক্রোফোন ভালবাসে। টিভি চ্যানেল কারও বাইট নিতে গেলে দেখেছি, একটা প্রবণতা থাকে প্রথমেই দু’হাতে বুমটা ধরে নেওয়ার। যাতে চাইলেও কেউ সেটা সরিয়ে না নিতে পারে। এখন অবশ্য রিপোর্টাররা সতর্ক হয়ে গিয়েছে। তারা আর কাউকে বুম ছুঁতে দেয় না। বেশ করে!
পাবলিক স্পিকিং নিয়ে বরাবর একটা কৌতূহল আছে। সেটা বক্তৃতাই হোক বা টিভি কমেন্ট্রি। ইডেনে রনজি ট্রফি সেমিফাইনাল দেখতে গিয়ে বিষয়টা নিয়ে লাঞ্চের সময় দীপের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দীপের কমেন্ট্রি আমার বেশ লাগে। যেখানে শুরু করেছিল, সেখান থেকে নিজেকে ঘষেমেজে অনেক, অনেকটাই ধারাল করেছে। ও বলছিল, কিছু কিছু জিনিস প্রোডিউসাররা বলে দেয়। আর কিছু কিছু রুল নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়। বলেছিল, ‘ওয়াসিমভাই খুব হেল্প করেছিল। ও যখন চ্যানেল নাইনে কমেন্ট্রি করত, তখন ওরা একটা ডু’জ অ্যান্ড ডোন্ট্স দিয়েছিল। ও সেটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেটা থেকেও অনেককিছু শিখেছি।’ দীপের কাছ থেকে জেনে অবাক লেগেছিল যে, ওর মতে এখন প্রাক্তন ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম ভাল কমেন্টেটর হল ইয়ান বিশপ। দীপ বলেছিল, ‘বিশ একা যে কোনও শো টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। ও এতটাই পড়াশোনা করে এক একটা সিরিজ কভার করতে আসে।’
দুপুর ২.০৫
বাইপাস বরাবর হোর্ডিংগুলো সমস্ত ফাঁকা। কঙ্কালের মতো কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে আছে শুধু। পটভূমিকায় নীল ঝকঝকে আকাশ। অতিকায় একটা ভাঙাচোরা ফিল্মসেটের মতো লাগছিল।
সত্যিই তো। কীসের হোর্ডিং দেবে? কোন পণ্যের? কোন বাণিজ্যিক বিপণনটা এখন হবে? মানুষের তো এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জীবাণুনাশকের। যেমন এখন টিভি–তে দেখি সমস্ত পণ্যই কোভিড আর করোনা অ্যাঙ্গলে চলে গিয়েছে। টুইঙ্কল খান্না সোনামুখ করে বলছেন, কীভাবে জীবাণুনাশক দিয়ে টেব্লটপ বা গোটা বাড়ি শুদ্ধ করবেন। বাইপাসের ধারে এইসমস্ত হোর্ডিংয়েও নিশ্চয়ই একদিন ওগুলোরই বিজ্ঞাপন দেখতে পাব।
বিকেল ৪.১৩
শোক আর আনন্দ— কোনওটারই বহিঃপ্রকাশ আর আলিঙ্গন দিয়ে হবে না। শোকের সময় মানু্ষ মানুষকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে পারবে না। আবার আনন্দেও একে অপরকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। শ্মশানে বহ্নিমান চিতার পাশে দাঁড়িয়ে কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে পাশের লোকটার কাঁধে মাথা রাখতে পারবে না। রাখতে পারবে না হাতে হাত। আবার ঈদে বা বিজয়ায় বন্ধুরা এড়িয়ে যাবে পারস্পরিক কোলাকুলি।
কী দিন এল! কী দিন আসছে!
সন্ধ্যা ৭.৩৬
আবার পুর প্রশাসন নিয়ে গোলমাল। কলকাতার মতোই শিলিগুড়িতেও প্রশাসকমন্ডলী বসানোর নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। কিন্তু সমস্যা হল, শিলিগুড়িতে পুরবোর্ড বিরোধী বামফ্রন্টের। সেখানে বিদায়ী মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বেঁকে বসেছেন। সটান বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি মুখ্য প্রশাসক হতে চান না।
এতে একটু রাজনীতিও আছে।
অশোকের বিবৃতি বলছে, তাঁর অধীনস্থ প্রশাসকমন্ডলীতে বিদায়ী মেয়র পারিষদদের রাখা হয়েছে। কিন্তু তারই পাশাপাশি তৃণমূলের পাঁচজনকেও রাখা হয়েছে। যারা সেখানে বিরোধীদল। অথচ, কলকাতা পুরসভার প্রশাসকমন্ডলীতে বিরোধীদের কাউকে রাখা হয়নি। অশোকের প্রশ্ন— শিলিগুড়ির ক্ষেত্রে কেন এই ব্যতিক্রম? তাঁর বক্তব্য, তাঁরা এই নির্দেশ মানছেন না। প্রশাসক বসাতে হলে কলকাতা–সহ রাজ্যের অন্যান্য পুরসভার মতোই বসাতে হবে।
এই খেলাটাও চলবে। দেখা যাক।
সন্ধ্যা ৭.৫৬
মানস’দাকে ফোন করলাম। বলল, দেবেশবাবুর টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। একটু পরেই নার্সিংহোম থেকে মরদেহ নিয়ে ওরা বেরিয়ে একবার বাড়ি হয়ে সোজা চলে যাবে রতনবাবুর ঘাটে। আজ রাতেই অন্ত্যেষ্টি।
আরও একটা পর্ব শেষ হয়ে গেল বিনা আড়ম্বরে। কিন্তু স্বস্তিতে। দেবেশবাবুর শেষযাত্রায় কোভিডের ছোঁয়া না থাকার স্বস্তি।
রাত ৮.৪৫
কালার্স বাংলা চ্যানেল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চারটি ধারাবাহিকের সঙ্গে জড়িত সকলকে কার্যত অন্ধকারে রেখে। অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, কলাকুশলী সকলকেই। কাল রাত থেকেই ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দেখছি।
বিনোদন জগতে করোনার থাবা পড়েই গেল অবশেষে।
রুদ্রনীল একটা পোস্ট করেছে — ‘ মুখে কেউ কিছু বলছি না। কিন্তু আমরা আর কতদিন টানতে পারব জানি না।.. আমাদের পিএফ, গ্র্যাচুইটি কিছু নেই। পেটে খাবার থাক না থাক, হাসিমুখে সেজেগুজে থাকতে হয় জাস্ট জীবিকার নিয়মে।.. যদি আপনাদের বাড়িতে বা পাড়ায় এঁরা ভাড়া থাকেন, সাধ্যমতো একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। তাড়িয়ে দেবেন না’।
রাত ১০.৪৭
মণিপুরের ১৮৫ জন নার্স শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তাঁদের রাজ্যে ফিরে গিয়েছেন। মণিপুর সরকার তাঁদের জন্য বাস পাঠিয়েছিল। এতজন নার্স শহর ছেড়ে যাওয়ায় পরিকাঠামো সঙ্কটে পড়বে তো বটেই। হাসপাতাল কর্তাদের মনে হয়েছে, এরপর স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে। যদি না দ্রুত অন্য রাজ্য থেকে নার্স এনে সেই খামতি ভরাট করা যায়।
কিন্তু এঁরা মণিপুরে ফিরে গেলেন কেন?
কারণ, এঁদের পাড়া–পড়শিরা প্রকাশ্যেই এঁদের ‘করোনাভাইরাস’ বলে ডাকছিলেন। অশিক্ষিত, বাচাল এবং অতিচালাক বাঙালি মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ, চোখ, নাক দেখে এঁদের চিনের নাগরিক বলে ভুল করেছিল। এবং যেহেতু করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চিনে, তাই এঁদের সেই ভাইরাসের বাহক বলে প্রকাশ্যেই দেগে দিতে শুরু করেছিল। কোথাও অ্যাপক্যাবের চালক, কোথাও পাড়ার বাসিন্দা প্রকাশ্যেই গজগজ করছিল এঁদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।
কোথায় যেতেন এঁরা? এই নির্বোধ শহরে পড়ে থাকতেন? একটা লোকও এঁদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি। কেউ প্রোটেক্ট করেনি। বরং ইন্ধন দিয়েছে। এখন এঁরা সেই সামাজিক চাপে শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। বেশ করছেন!
আর আমরা বাঙালি, মাইক ধরে এখনও বাগাড়ম্বর করছি— ‘সব ঠিক হ্যায়!’
একদম ঠিক কথা—-ভিন রাজ্যে র নার্স রা ঠিক কাজ করেছে। তবে এতে ও বাংলা র মানুষ দের কোনো শিক্ষা হবে না। খুব ভালো লাগল তোমার লেখা।
শেয়ার করলাম।
LikeLike
ধন্যবাদ
LikeLike
খুব ভালো লেখেন কিন্তু আপনার একটা লেখা আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।সেটা হলো ধনঞ্জয় এর ফাঁসির পরের দিন আপনার লেখা।সম্ভবত তখন আনন্দবাজার এ ছিলেন।
LikeLike
Dhobyobad. Oi lekhata anandabazar ei beriyechhilo
LikeLike