
০৭.০৫.২০২০। বৃহস্পতিবার
বেলা ১১.১৭
বিশাখাপত্তনমের কারখানা থেকে গ্যাস লিক করে হাজারের উপর মানুষ অসুস্থ। মৃত্যু হয়েছে একটি শিশু–সহ ১১ জনের। হাসপাতালে ভর্তি শতাধিক। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৮০ জন সঙ্কটজনক। সকাল থেকে টিভি খুলিনি। ভাল লাগছিল না। ঠিকই করেছিলাম। খুলেই তো এই খবর! খারাপ লাগাটা আরও বেড়ে গেল। আর একলহমায় এসে ধাক্কা মারল ওই ৩৬ বছর আগের ছবিটা। যেমন কোথাও গ্যাস লিকের খবর পেলেই ধক করে এসে বুকে লাগে।
এবড়ো খেবড়ো কাদামাটির স্তূপের মধ্যে শুয়ে এক নিথর শিশু। শুধু মুখটুকু বেরিয়ে। বিষাক্ত গ্যাসের তীব্রতায়, শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে গিয়েছে দুটো খোলা চোখের মণি। শিশুটির মাথায় একটি পুরুষালি হাত। বোধহয় সেই হতভাগ্যের কোনও আত্মীয়ের। নাকি তার বাবারই। কে জানে! তখনও এই পেশায় আসিনি। কিন্তু ছবিটা চিরকালীন স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে। আইকনিক। পৃথিবীর যেখানেই গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটুক, ছবিটা হেঁটে এসে হাজির হয়। তারপর ধাওয়া করতে থাকে। করতেই থাকে। যেমন এখন করছে।
প্রায় কাছাকাছির একটা দৃশ্য চোখে দেখেছিলাম। ২০০৪ সালে সুনামির পর তামিলনাড়ুর নাগাপট্টিনম মৎস্যবন্দরে। ঢেউয়ের ঝাপটে চারতলা, তিনতলা, পাঁচতলা, ছ’তলা ট্রলারের স্তূপ। একটা আরেকটার উপর উঠে গিয়েছে। ঠিক বহুতল বাড়ির মতো। ঘটনার তিনদিন পরেও সেগুলোর খাঁজখোঁজ থেকে ঝুলছে মৃতদেহ। রাইগর মর্টিস ধরে শক্ত হয়ে গিয়েছে। করাত দিয়ে কেটে কেটে বার করে লাদাই করা হচ্ছে ট্রাকে।
কত লোক মারা গিয়েছিলেন? বেসরকারি হিসেবে শুধু নাগাপট্টিনমেই আট হাজার। একটা শহর কয়েক মিনিটে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। সারা রাত গাড়িতে ট্রাভেল করে যখন ভোরবেলায় গিয়ে পৌঁছলাম, চারদিকে মৃত্যুর আঁশটে গন্ধ। টন টন ব্লিচিং পাউডারও সেই গন্ধ চাপা দিতে পারেনি।
সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে যখন ফিরছি চেন্নাইয়ের পথে, তখন শহরের উপান্তে এক মাঠে গণকবর খুঁড়ে গোর দেওয়া হচ্ছে নিহতদের। সেই মাঠের চারপাশে একটানা চাপা গোঙানির মতো কান্না এখনও মনে মনে কান পাতলে শুনতে পাই। শুনতে পাই, কীভাবে চাপা আওয়াজটা আস্তে আস্তে চৌদুনে উঠে সমবেত হাহাকার হয়ে আছড়ে পড়ল চরাচরে। সেই বুকফাটা আর্তনাদের মধ্যে কবরে শোওয়ানো নিথর শিশুর কপালে তার বাবা এঁকে দিচ্ছিলেন স্নেহচুম্বন। ঝুঁকে পড়ে সন্তানের মুখে বুলিয়ে দিচ্ছিলেন পাউডারের পাফ। শেষযাত্রার সাজ। পরম যত্নে পকেট থেকে ক্যাডবেরির প্যাকেট বার করে রেখে দিচ্ছিলেন শিশুদেহের পাশে।
আদিগন্ত বিস্তৃত সেই শোকভূমিতে শুধুমাত্র ওই একটি লোকের চোখে জল ছিল না। পাথরের মতো চেহারাটার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও কথা বলতে পারিনি। মনে হয়েছিল, ওই তো তাসের ঘর। টোকা দিলে যদি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে!
আজ বিশাখাপত্তনমের কারখানা থেকে বেরিয়ে আসা ঝাঁঝালো গ্যাসে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় আবার ফিরে এল ছবিগুলো।
টিভি–তে দেখছি, অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে রওনা হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে আছেন অমিত শাহ এবং রাজনাথ সিংহ। করোনার জন্য মজুত ভেন্টিলেটর লাগানো হয়েছে শ্বাসকষ্টে ভুগতে–থাকা অসুস্থদের রিলিফ দিতে। সকলকে বলা হয়েছে মাস্ক জলে ভিজিয়ে মুখে পরতে। নিহতদের পরিবারকে ১ কোটি টাকা করে অর্থসাহায্য ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। কারখানা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়েছে গ্যাস। তিনটে গ্রাম খালি করা হয়েছে। কিন্তু অভিঘাত তো থাকবেই। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, অসুস্থ এবং নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এসব ঘটনায় মৃত্যু কম ট্যাক্স চাপায় না।
বেলা ১১.৩৪
আজ ঘুম থেকে ওঠা ইস্তক ডানদিকের কলারবোনে একটা টান লাগছে। সম্ভবত শোওয়ার দোষে। বই পড়ার জন্য মাথাটা উঁচু রাখতে হয় বলে এমনি বালিশের বদলে কোলবালিশ মাথায় দিয়ে শুই। সম্ভবত বেকায়দায় টান লেগেছে। অনেকে বলে, বালিশ ছাড়া ঘুমোন উচিত। সেটাই স্বাস্থ্যকর। কিন্তু চেষ্টা করেও পারিনি। অত কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারলে তো সন্ন্যাসীই হতাম।
বেলা ১১.৪৫
আজ বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সারা দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে দাঁড়ান। এই সঙ্কটকালে গোটা পৃথিবী ভারতকে স্মরণ করেছে। এবং মানবতার প্রশ্নে ভারত সারা পৃথিবীর পাশে দাঁড়িয়েছে।’
বিন্দুমাত্র দেরি না করে তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী টুইট করেছেন, ‘বুদ্ধপূর্ণিমায় কি দেশের গরিব মানুষদের জন্য কোনও বার্তা আছে? এটাই কি মানবিকতা?’
দুপুর ১২.৩০
গুবলু, গুবলু, গুবলু। বিগ গুবলু।
গুবলুর কেন্দ্রে কলকাতা পুরসভায় প্রশাসক বসানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি। গুবলুর রচয়িতা রাজ্যপাল। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর কলকাতা পুরসভায় প্রশাসক বসানো হচ্ছে। সেই মর্মে গতকালই বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে। তাতে বেজায় ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল। তিনি সকাল সকাল টুইট করেছেন মুখ্যসচিবের উদ্দেশে। বলেছেন, বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগে তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনাই করা হয়নি। তাঁর কাছে সেই মর্মে কোনও খবরও ছিল না। অথচ, মিডিয়ার হাতে হাতে বিজ্ঞপ্তি ঘুরছে। এটা হতে পারে না। অবিলম্বে যেন বিজ্ঞপ্তিটি রাজভবনে পাঠানো হয়।
দ্বিতীয়ত, ওই বিজ্ঞপ্তি খারিজ করার আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে পিটিশন করেছেন উত্তর কলকাতার এক বাসিন্দা। তিনি জানাচ্ছেন, এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে হাইকোর্ট আবেদনের শুনানি দ্রুত না করতে পারলে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যেতেও তৈরি। তবে শোনা যাচ্ছে, হাইকোর্টে আগামী সপ্তাহে শুনানি হতে পারে।
তৃণমূলের সাংসদ সৌগত রায় অবশ্য সাফ জানিয়েছেন, রাজ্যপালের জন্যই অর্ডিন্যান্স না এনে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘প্রশ্ন হল, এর জন্য রাজ্যপালের অনুমতি লাগে কি লাগে না? উত্তর হল: না। লাগে না। সরকার অর্ডিন্যান্স এনে করতেই পারত। কিন্তু যেখানে জগদীপ ধনকড়ের মতো রাজ্যপাল আছেন, সেখানে সরকার অর্ডিন্যান্স না এনে পুর আইন দেখে, বিচার বিবেচনা করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।’ ঠিকই। অর্ডিন্যান্স আনলে তো আবার সেটা রাজভবন থেকে সই করিয়ে আনতে হতো। সে সই করার কলম যদি হারিয়ে যায়? রিস্ক তো নেওয়া যায় না।
মনে হচ্ছে গুবলুটা ‘বিগ’ থেকে ‘বিগার’ হতে পারে। দেখা যাক।
দুপুর ১২.৪৫
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, করোনাভাইরাসের আক্রমণ পার্ল হারবার এবং ৯/১১ হামলার চেয়েও বিধ্বংসী। মৃতের সংখ্যা ধরলে সেটা ভুলও নয়। এখনও পর্যন্ত আমেরিকায় করোনায় মৃতের সংখ্যা ৭৩ হাজারেরও বেশি। গত ২৪ ঘন্টাতেই মারা গিয়েছেন ২,০৭৩ জন। তবু পার্ল হারবার বা ৯/১১ হামলার সঙ্গে তুলনা করলে কেমন যেন একটু লাগে। সেটা হয়তো দুটো ঘটনার আকস্মিকতা এবং তাৎক্ষণিক অভিঘাতের জন্য।
পার্ল হারবার হামলার সময় জন্ম হয়নি। ওটা দেখা হলিউডের যুগান্তকারী ছবিতে। তার মধ্যে বীরত্ব, গরিমা, রোমান্স— সব মিলেমিশে একাকার। যুদ্ধের বাস্তবতা সেখানে খানিক ঢাকা পড়েছে সিনেম্যাটিক স্বাধীনতার কাছে। কিন্তু ৯/১১ হামলার অকুস্থলটা দেখেছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল ২০০১ সালে। আমি নিউ ইয়র্কে যাই ২০০৫ সালে। সেই প্রথম। এখনও পর্যন্ত সেই শেষ। গিয়েছিলাম অন্য অ্যাসাইনমেন্টে। কিন্তু ‘মাদার অফ অল ইনসিডেন্ট্স’ যেখানে ঘটেছিল সেখানে যাব না, তা তো হতে পারে না। সাবওয়ে ধরে চলে গেলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্টেশনে।
এসকালেরটর দিয়ে উপরে উঠে ডানদিকে গেলেই গহ্বরটা। টুইন টাওয়ার যেখানে ভেঙে পড়েছিল। দোতলা সমান উঁচু তারের জালে ঘেরা। একঝলক দেখলে মনে হয়, দাঁত তোলার পর মাড়িতে গভীর খোঁদলের মতো। সেখানে ততদিনে পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রাণপণে অতীত ভুলে চারপাশে খুশিয়াল নিউ ইয়র্ক শহর। ছুটছে, খেলছে, দৌড়চ্ছে। তারের জাল ধরে ধরে এগিয়ে গহ্বরের যথাসম্ভব কাছাকাছি গেলাম। জালের অন্যপাশে একটা আয়তাকার ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে হামলায় চিরকালীন নিখোঁজদের পরিজনেরা বার্তা লিখে গিয়েছেন। বোর্ডের নীচে শুকনো ফুলের তোড়ার স্তূপ।
মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করলাম— পরপর দুটো প্লেন আকাশ চিরে এসে এসে ঢুকে যাচ্ছে দুটো অতিকায়, গগনচুম্বী টাওয়ারে। আচমকা চারদিক নিঝুম হয়ে গেল। থেমে গেল সমস্ত ছুট, খেলা, দৌড়। মনে হল আগুনের গোলা আর গলিত কংক্রিট নেমে আসছে অন্তরীক্ষ থেকে। চমক লাগল! দৌড়ে বেরিয়ে এলাম ঘেরাটোপ থেকে। ট্রেন ধরে সোজা ডাউনটাউন ম্যানহাটানের হোটেলে।
করোনাভাইরাসের ছোবল এর চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং মারণশীল হতে পারে। কিন্তু দৃশ্যত এবং তাৎক্ষণিক অভিঘাতে এর চেয়েও ভয়াবহ? কে জানে!
দুপুর ১.০০
আজ শুরু হচ্ছে ‘বন্দে ভারত মিশন’। বিদেশে যেখানে যেখানে ভারতীয়রা লকডাউনে আটকে পড়েছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনার অপারেশন। বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ পাঠানো হচ্ছে বলে জানাচ্ছে টিভি। দুনিয়ার ইতিহাসে এটাই নাকি হতে চলেছে বৃহত্তম ইভ্যাকুয়েশন প্রসেস।
এঁদের কাছে কি বিমান বা জাহাজের ভাড়া নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল? পরিযায়ী শ্রমিকদের মতো?
দুপুর ১.৪০
ফেসবুকে অনেকে আজই রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে। লিয়েন্ডার পেজ যেমন ইনস্টাগ্রামে ‘শুভ জন্মদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ বলে ভিডিও পোস্ট করেছেন। তাহলে কি আজই পঁচিশে বৈশাখ? ইংরেজি–বাংলা তারিখ একটু গুলিয়ে ফেলি। ফলে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনে কাগজ খুলে দেখলাম। প্রথম পাতায় মাস্টহেডের নীচে পরিষ্কার লেখা ২৪ বৈশাখ। তাহলে? রবীন্দ্রনাথ কি দু’দিন ধরে জন্মেছিলেন? এটা কি ইংরেজি তারিখ আর বাংলা তারিখের দ্বন্দ্ব? কিন্তু দ্বন্দ্ব কেন হবে? রবীন্দ্রনাথ তো বাঙালিই ছিলেন! নাকি সকলে ‘হ্যাপি বার্থডে ইন অ্যাডভান্স’ করছেন?
দুপুর ১.৫১
তৃণমূল সাংসদ অপরূপা পোদ্দার কন্যাসন্তানের জননী হয়েছেন। সদ্যোজাতের নাম রাখা হয়েছে ‘করোনা’। অপরূপার স্বামী রিষড়া পুরসভার কাউন্সিলার সাকিব আলি বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস যে অশান্তি তৈরি করেছে, এর মধ্যেই আমাদের সন্তান শান্তি বয়ে আনবে। তাই ওর নাম রাখা হয়েছে করোনা।’ তবে করোনা ডাকনাম। পরে ভাল নাম রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘করোনাঞ্জলি’ হলে কেমন হয়?
বিকেল ৪.১০
আজ এডিট মিটিংয়ের পর অশোক’দা চুনী’দার গল্প বলছিলেন। কী সব অ্যানেকডোট। কী ক্যারিশম্যাটিক চরিত্র। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস— কী খেলেননি! এসব চরিত্র সত্যিই ক্ষণজন্মা। হোয়াট আ প্লেয়ার। অশোক’দা বলছিলেন, ‘চুনীদা ক্যারাম খেললেও চ্যাম্পিয়ন হতো। অল গ্রেট্স আর ব্যাড লুজার্স।’
বিকেল ৫.৪৫
আজ দু’বার দিলীপ ঘোষের মুখে দু’রংয়ের মাস্ক দেখা গেল। দুপুরে দেখেছিলাম কালো জমির উপর পদ্ম রংয়ের পদ্মফুল। এখন আবার দেখছি পদ্ম রংয়ের জমির উপর কালো সুতোর এমব্রয়ডারি করা পদ্ম। দুটো কি আলাদা মাস্ক? নাকি দুপুরেরটাই এখন পরতে গিয়ে উল্টো পরে ফেলেছেন? বোঝা গেল না। কৌতূহল হচ্ছে।
সন্ধ্যা ৬.২০
স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় টুইটারে ‘সহজপাঠ’এর কভার আর প্রথম পাতাটা পোস্ট করে লিখেছেন ‘প্রণাম’। মনে হল, তাঁকে একবার ফোন করে জিজ্ঞাসা করি। মেসেজ পাঠালাম। জবাব এল না। তবে টুইটার থ্রেডে দেখলাম, ইভান অর্ণব গোমস নামে একজন লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী কালকে। অ্যাট লিস্ট টু অল বেঙ্গলিজ। কাল ২৫শে বৈশাখ।’ স্বস্তিকা জবাবে লিখেছেন, ‘আজকে বললে কি রবি ঠাকুর বকবেন? কালকেও বলব। দু’দিন বললে অসুবিধাটা কোথায়?’
সন্ধ্যা ৭.১০
রাজ্যে গত ২৪ ঘন্টায় আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত আরও ৯২ জন। এটা কি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন? নাহ্, আজ তিনি আর প্রেসকে ব্রিফ করতে আসেননি। কেন আসেননি বুঝলাম না। যদিও নবান্ন থেকে জানতে পারলাম, গত দু’দিন তাঁকে ব্রিফ করতে পাঠানোটা ছিল সরকারি সিদ্ধান্ত। তাহলে কি তাঁকে আজ না পাঠানোটাও সরকারি সিদ্ধান্ত? স্বরাষ্ট্রসচিব বা অন্য কোনও আমলার অনুপস্থিতিতে আজকের তথ্য দিল স্বাস্থ্যভবনের বুলেটিন।
কাল যা লিখেছিলাম। বুলা’দির লুডো জারি আছে। আজ কলকাতা আবার মইয়ের তলায়। কনটেনমেন্ট জোনের সংখ্যা বেড়েছে।
বড়বাজারের দোকানপাট অন্যত্র সরানোর কথা ভাবা হচ্ছে। গত দু’দিন নাকি ওই এলাকায় সংক্রমণ বেড়েছে। তার কারণ, লকডাউন থাকা সত্ত্বেও ওই ঘিঞ্জি এলাকায় পণ্য নিয়ে বাইরের ট্রাক আসে। সেই বহিরাগত যানবাহন এবং তার চালক–খালাসিদের থেকে সংক্রমণ হতে পারে। এমনই বলেছেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। সেজন্য কলকাতা পুলিশের কাছে প্রস্তাব গিয়েছে, শহরের বাইরে কোথাও তুলনামূলক ফাঁকা জায়গায় বাজারটা সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কী যে হবে!
এইমসের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জুন–জুলাই মাসে করোনা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সেই ভয়াবহতার পরিমাণ নির্ভর করবে লকডাউনের সাফল্যের উপর। ডায়েরিতে ঠিকই লিখেছিলাম কয়েকদিন আগে— দ্য লাইট অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য টানেল ইজ অফ আ কামিং ট্রেন!
রাত ৮.১৫
নিউজ চ্যানেলের জনপ্রিয় শোয়ে অ্যাঙ্কর বলছেন, ভোপালের ওই ছবিটি ছিল একটি পুতুলের। চমৎকার!
পুতুল? বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্র্যাজেডিতে চোখের পলকে ২,০০০ মানুষের মৃত্যুর পরদিন যেখানে ভোপাল শহরে সেই দেহগুলি কবর দিতেও জমি পাননি তাঁদের পরিজনেরা, সেখানে একটি পুতুলকে কবর দেওয়া হবে! ওয়াহ্!
এখানে লেখা থাক, ওই একই ছবির দু’টি ফ্রেম তুলেছিলেন দুই ফটোগ্রাফার। পাবলো বার্থোলেমিউ এবং রঘু রাই। পাবলো তুলেছিলেন রঙিন ছবি। রঘু সাদা–কালো। পাবলোর তোলা ছবিটি ১৯৮৪ সালে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অফ দ্য ইয়ার’ হয়েছিল। রঘুর পুত্র নীতিন রাইয়ের সঙ্গে একসময় একই অফিস স্পেসে কাজ করেছি দিল্লিতে। ও ফটোগ্রাফার ছিল ‘সানডে’ ম্যাগাজিনে। আমি আনন্দবাজারের দিল্লি ব্যুরোয়। নীতিনের বিখ্যাত বাবার সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল ঘটনাচক্রে। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম ভোপালের ছবিটা নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, কোনওমতে ছ’টা–আটটা ফ্রেম তুলতে পেরেছিলেন। তখন সবে শিশুটির দেহে মাটি দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যেই দ্রুত শাটার টেপা। কারণ, তাঁর কাছে ওই একটি ফ্রেমই ছিল গোটা ট্র্যাজেডির ধারক। আইকনিক। রঘু রাইয়ের চোখ ভুল ভাবেনি।
এখনও মনে আছে, রঘু বলেছিলেন ‘মোস্ট পাওয়ারফুল অ্যান্ড মুভিং মোমেন্ট অফ দ্য ট্র্যাজেডি’। আর বলেছিলেন, ছবিটা তোলার পর পাবলো এবং তিনি— দু’জনেই সেখানে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
ওটা নাকি পুতুলের ছবি! হাঃ!
রাত ১০.১৩
কাদামাটির স্তূপে শুয়ে নিথর শিশু। শুধু মুখটুকু বেরিয়ে। বিষাক্ত গ্যাসের তীব্রতায়, শ্বাসকষ্টে নীল দুটো খোলা চোখের মণি।
ও পুতুল ছিল না।
চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। বড্ড কষ্ট।
নন্দিতা ভট্টাচার্য
LikeLike
কী আর বলব…
LikeLike