
০৪.০৫.২০২০। সোমবার
সকাল ৮.০৫
কাল রাতে বাড়িতে ঢোকার সময় ব্যাপক স্কিল দেখিয়েছি। কাঁধে আড়াআড়ি অফিসের ব্যাগ ঝুলছে। একহাতে দুটো প্যাকেট। অন্যহাতে ডেলিকেটলি ব্যালান্স করা ৩০টা ডিম ভর্তি পিচবোর্ডের ক্রেট। সুতলি দড়ি দিয়ে বাঁধা। ট্র্যাপিজের খেলা খেলতে খেলতেই প্যাকেটদুটো আঙুলে ঝুলিয়ে ওই হাতে চাবি নিয়ে গেটের তালা খুলে ফেললাম। এরপর অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হবে। হোঁচট খেলে পড়ে গিয়ে ডিম ফাটবেই।
রাস্তা দেখানোর আলো চাই। একতলার আলো জ্বালানো যেত। কিন্তু এখনও সুইচ মুখস্থ হয়নি।
এইবার স্কিলের খেলা। মোবাইলের টর্চটা অন করে সেটাকে এমনভাবে ট্রাউজারসের পকেটে রাখলাম, যাতে মোবাইলটা পকেট থেকে আলোসমেত মুণ্ডুটা বার করে রাখে। তারপর পা ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে বাঁকিয়ে (কারণ, পা সোজা করলে পকেটও সোজা হয়ে টর্চ–সহ মোবাইল সেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে) আস্তে আস্তে একতলা থেকে দোতলায় উঠলাম। ডিম অক্ষত। আমিও। হাতের প্যাকেটও অক্ষুন্ন। ইয়েস!!!
সকাল ৮.২৫
কাল বেশি রাতে দিব্য’দা ফোন করেছিল। বহু, বহুদিন পর। এই একেকটা ফোন পুরোন দিনের জানালাগুলো সব হাট করে খুলে দেয়। এটা একেবারেই কাকতালীয় যে, কাল রাতে অফিসের বারান্দায় বসে মুড়িয়ে মাথার পিছনের চুল কাটার সময় দিব্য’দার মুখটাই ভেসে উঠেছিল। কারণ, বহুকাল ধরে দিব্য’দা মুণ্ডিতমস্তক। ওটাই ওর স্টাইল। টকটকে ফর্সা রং। মোটা গোঁফ আর ন্যাড়ামাথা। দেখানো উচিত ছিল বলিউডের ভিলেনের মতো। কিন্তু ভিলেনদের আবার এত সুন্দর দেখতে হয় না।
একদা আলোড়ন–ফেলা অনুসন্ধানমূলক টিভি প্রোগ্রাম ‘খোঁজখবর’–এ জনক দিব্য’দা একসময়ে আনন্দবাজারে কাজ করত। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বও ঠিক নয়। স্নেহের সম্পর্ক। কেন জানি না, দিব্য’দা আমায় খুবই স্নেহ করত। একুশে জুলাই পুলিশের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে যখন আমি হাসপাতালে ভর্তি, দিব্য’দা দেখতে গিয়ে মাথায় হাত রেখেছিল। সেই স্পর্শের মধ্যে কোথাও একটা বড়দা–সুলভ আশ্বাস ছিল। সেই ছোঁয়াটা আজও মিস্ করি। কালক্রমে আমি, দিব্য’দা আর আমার সঙ্গে একইদিনে আনন্দবাজারে জয়েন–করা নন্দিনী একটা গ্রুপ হয়ে গেলাম। অ্যাসাইনমেন্টের ফাঁকে তিনজন মিট করে গড়ের মাঠে গিয়ে ফুচকা খেতাম। কখনও আউট্রাম ঘাটের ‘গে’ রেস্টুরেন্টে গিয়ে আইসক্রিম। এমনও হয়েছে যে, তৎকালীন চিফ রিপোর্টার শ্যামল’দার থেকে গাড়ির স্লিপ সই করিয়ে দুপুরে ওঁর সল্টলেকের বাড়িতে গিয়ে বৌদির কাছে আব্দার করে লুচি–আলুরদম খেয়ে আবার সোনামুখ করে অফিসে ফিরে এসেছি। শ্যামল’দা জেনেছেন রাতে বাড়ি ফিরে। কারণ, বৌদিকে পইপই করে বলা ছিল ঘুণাক্ষরেও যেন মুখ না খোলেন। বিরাট কেস খাব।
এসব কাহিনি নন্দিনী আবার নাইট ড্রপে বাড়ি ফেরার সময় ম্যাগাজিনের এক মহিলাকর্মীকে বলেছিল। তিনি তো বেজায় উত্তেজিত, ‘তার মানে তোমাদের আনন্দবাজারে তেমন কোনও কাজই নেই?’ নন্দিনী বলেছিল, ‘নাহ্, কাজ আর কোথায়। ওই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে একটু ঘুরেটুরে, খাওয়াদাওয়া করে আবার অফিসে ফিরে আসি। ওটাই কাজ।’ সম্ভবত সারারাত চিন্তাভাবনা করে ওই মহিলা পরদিনই ম্যাগাজিন থেকে আনন্দবাজারে ট্রান্সফার হওয়ার দরখাস্ত করেন। একমাসের মধ্যে তাঁকে আনা হল আনন্দবাজারে। কিন্তু দেখা গেল, ডিপ ফাইন লেগেও লুকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ইন ফ্যাক্ট মাঠে না নামাতে পারলেই ভাল হয়। নন্দিনীর কাছে একদিন তিনি অভিযোগও করলেন, ‘তুমি তো আমাকে কমপ্লিটলি মিসগাইড করেছিলে! এখানে তো প্রচন্ড কাজের চাপ। আমি ভাবলাম, ম্যাগাজিনে অত চাপ। তাই ডেইলিতে গিয়ে দেখি। এখানে তো দমই ফেলতে পারছি না।’
নন্দিনী বলেছিল, ‘ম্যাগাজিনের চেয়ে ডেইলি কাগজে কাজের চাপ কখনও কম হয়? হয় না যে, সেটা তো তো একটা শিশুও জানে। তুমি যদি ইয়ার্কিকে সিরিয়াসলি ধরে ট্রান্সফার নিয়ে বসো তাহলে আমি কী করব!’
কিন্তু দৈনিক কাগজের কাজের চাপে যে নিয়মিত ভেঙে পড়ে, তাকে কে আর দায়িত্ব দিয়ে নিজের কাজ কঠিন করতে চায়? ফলে তাঁকে ডিপ ফাইন লেগ থেকে দ্রুত গ্যালারিতে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল। তেমন একটা সময়েই এক রাতে নিকটবর্তী পানশালা থেকে মহিলার বস্ ফেরার পর তিনি গুনগুন করে অনুযোগ করতে থাকেন, দারুণ কর্মদক্ষ হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ পলিটিক্স করে তাঁকে কোনও কাজ দেওয়া হচ্ছে না। শুনে মেজাজি এবং ততক্ষণে হুইস্কিতে আরও ফুরফুরে বস্ মহিলার মুখের সামনে দুটো হাত তুলে ধরে বলেন, ‘তুমি কি জানো আমার এই ১০ টা আঙুলই প্লাস্টিক সার্জারি করা?’
— তাই? জানতাম না তো! প্লাস্টিক সার্জারি কেন?
বি’কজ আই হ্যাভ বার্নড মাই টেন ফিঙ্গার্স আফটার আই হ্যাভ টেক্ন ইউ!
কথোপকথন সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
দিব্য’দার ফোন পেয়ে সেই দিনগুলো মনে পড়ে গেল। কিন্তু দিব্য’দার কেন মনে পড়ল আমার কথা? শোনা গেল, ‘তোর কথা মনে পড়ল আজ সকালে কাটলেট বানাতে গিয়ে। মনে আছে একদিন আমি, তুই, নন্দিনী কাটলেট খেতে গিয়েছিলাম বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে? দুটো একটু আগে ভাজা কাটলেট ছিল আর একটা তখনই ভাজা। নন্দিনী হাত বাড়িয়ে সদ্যভাজাটা প্লেট থেকে তুলে নিয়ে একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, গরমটাই নিই?’
মনে পড়ল। এ–ও মনে পড়ল যে, তারপর থেকে খাবার এলেই আমরা বলতাম, গরমটাই নিই? আর নন্দিনী প্রচণ্ড বিব্রত হতো।
খুব হ্যা–হ্যা করে হাসলাম দু’জন। গরমটাই নিই!
সকাল ৮.৫৫
কাল রাতে অস্কার ট্রফির মতো কৃষ্ণবর্ণ, তণ্বী এবং সুশ্রী বোতলে সয়া সস এসেছে। এটি মাংস ভাজার এক্সপেরিমেন্টে ব্যবহার করা হবে। আমি অবশ্য অনেক বেশি প্রসন্ন হয়েছি বোতলটা বাব্ল র্যাপে মুড়ে পাঠানোয়। পুটপুট করে বাব্লগুলো ফাটাতে যে কী ভাল লাগে! ঘুমোতে যাওয়ার আগে অনেকক্ষণ ধরে মহা আনন্দে ফাটালাম। আরও একটু বেশি থাকলে সারা রাত ধরেও ফাটাতে পারতাম। ওটায় আমার কোনও ক্লান্তি নেই।
শুনেছি, ঠাট্টা করে মনোবিদ্যার ভাষায় একে বলা হয়, ‘ওসিডি – অবসেসিভ কম্প্রেসিভ ডিসঅর্ডার’ ।
বেলা ১১.০২
সঞ্জয়’দা ফোন করল। আনন্দবাজারের প্রাক্তন সহকর্মী। কেরিয়ারের প্রথমদিকে কাজ শিখেছি সঞ্জয়’দার কাছে। পরে ‘এবেলা’ শুরুর সময় অভীকবাবুর অনুমতিসাপেক্ষে অবসরের পরেও সঞ্জয়’দাকে নিয়ে এসেছিলাম নতুনদের ট্রেনিং দিতে। স্মার্ট ব্যাচেলর এখন ৭০ বছরে। সাঁতার কাটতে পারছে না বলে খুব দুঃখ। আরও দুঃখ, সমস্ত চ্যানেলে পুরোন খেলা রিপিট করছে বলে। বলল, ‘এটা একটা সাম্যবাদী ভাইরাস। বুঝলি? ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেকে ভারতের ভিখিরি— সকলকে সমান ভালবাসে।’
বেলা ১১.১৬
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে গোলমাল ক্রমশ বাড়ছে। যে ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেনে তাঁদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে, শ্রমিকদের কাছেই তার ভাড়া চেয়ে বসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ এক আশ্চর্য দেশ! আরও আশ্চর্য তার শাসনকর্তারা। যে মানুষগুলোর সব গিয়েছে, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাদের উপরই আবার কোপ মারছে। এরা কি মানুষ? নাকি একেই ওয়েলফেয়ার স্টেট বলে? কল্যাণকামী রাষ্ট্র? মাই ফুট! রেলবোর্ডের এক কর্তা নাকি বলেছেন, ‘আমরা মানুষের ভাড়া না দেওয়ার অভ্যেসটা বদলাতে চাই।’ বোঝো ব্যাপার!
করোনা তাণ্ডবের ফলে যে ভারতীয়রা বিদেশে আটকে পড়েছিলেন, তাঁদের বিনাপয়সায় দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল সরকারি কেরিয়ার এয়ার ইন্ডিয়া। তাঁদের কাছে কিন্তু বিমানভাড়া চাওয়া হয়নি। অথচ, দেশের লাইফলাইন ভারতীয় রেল সেটা করে দেখাতে পারল না। ছি–ছি!
এই আবহে সনিয়া গান্ধী বলেছেন, পরিযায়ী শ্রমিকরা যে যে রাজ্যের মানুষ, সেই রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস তাঁদের রেলভাড়ার টাকা দিয়ে দেবে। নিঃসন্দেহে এটাও পলিটিক্স। কিন্তু সময়োপযোগী রাজনীতি। গুড পলিটিক্স। কারণ, তার পরেই বিজেপি–র এমপি সুব্রহ্ম্যণম স্বামী টুইট করেছেন সরকারকে ‘নির্বোধ’ বলে। তার কিছুক্ষণ পর আরও একটি টুইটে দাবি করেছেন, তিনি রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের অফিসের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর নাকি ঠিক হয়েছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের ভাড়ার ৮৫ শতাংশ দিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। বাকি ১৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট রাজ্য। বোঝা যাচ্ছে, সনিয়ার ঘোষণায় চাপ খেয়েছে কেন্দ্র।
হাজার হাজার নাচার মানুষের প্রতি দেশের সরকারের এই ক্যালাস অ্যাটিটিউড আর তাদের নিয়ে এই রাজনীতি দেখে ঘেন্না হয়। নিস্ফল ক্রোধ হয়। দিনের পর দিন দেখি সাহায্য করে পলিটিক্যাল মাইলেজ নেওয়ার জন্য জিভ বার করে বসে থাকে নেতারা। আর অসহায় মানুষগুলো দরজায় দরজায় লাট খেতে থাকে।
দুপুর ১২.২০
আজ এতক্ষণে ওয়ার্কআউট করে উঠলাম। পরপর কয়েকটা রাত ভাল করে ঘুম হয়নি। খুব ক্লান্ত লাগত। আজও লাগছিল। ভেবেছিলাম, আজ ফাঁকি মেরে ল্যাদ খাই। বাইরে কেঠো গরম। ঘর থেকে বেরোলে চোখমুখে ঝাঁ ঝাঁ করে তাপ এসে লাগছে। ওয়ার্কআউট করলে ব্যাপক ঘামব। ফলে আজ বাদ থাকুক। সেইমতোই এগোচ্ছিলাম। তারপর মনে হল, নাহ্, করেই ফেলি। শৃঙ্খলাটা রাখা দরকার। আড় ভেঙে ঘামটা ধরালে একটু ঝরঝরেও লাগে। কয়েকটা আইটেম কম করলাম অবশ্য। তবু হাঁফ ধরল। তবু ঘাম ঝরল। তবু জলতেষ্টা পেল।
দুপুর ১.৪৫
ওরেব্বাস! কী কান্ড হচ্ছে দেশে। টিভি–তে দেখছি, ইস্ট দিল্লির মদের দোকানের সামনে অষ্টমীর সন্ধ্যার একডালিয়ার মতো ভিড়। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংকে চুলোর দোরে দিয়ে হাজার হাজার লোক ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি করছে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। কিলোমিটার পর কিলোমিটার লম্বা, বিসর্পিল লাইন চলে গিয়েছে কতদূর কে জানে। আর ঢেউয়ের মতো মানুষ এসে আছড়ে পড়ছে ওয়াইন শপের গেটে। বেলা ১২টার মধ্যে নাকি স্টক শেষ। তা–ও দেড়হাজার লোক লাইনে দাঁড়িয়ে। লাঠি ঠুকে ঠুকে পুলিশ নিয়ন্ত্রণের একটা চেষ্টা করছে বটে। কিন্তু এভাবে কি আর ওই জলতরঙ্গ রোধ করা যায়?
টিভি–তে দেখছি, কলকাতায় হাজরার কাছে একটা দোকানের সামনেও থিকথিক করছে ক্রেতা। পুলিশ ভিড় সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। শেষে নাকি লাঠিচার্জ করে ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে হয়েছে। কয়েকজনকে আটক করে থানাতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আলিপুরদুয়ারে আবার কড়া রোদ্দুরে লাইনে দাঁড়ানোর কষ্ট সইতে না–পেরে ইট দিয়ে লাইন রেখে ছায়ায় গিয়ে অপেক্ষা করেছেন পিপাসুরা।
ভাবছিলাম, করোনার ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে এই লাইন পড়ত? কে জানে! মদ্যপান করি না। ফলে এই আকুলতা ঠিক বুঝতে পারছি না। পৃথিবীর যাবতীয় সুরারসিকদের ডিউ রেসপেক্ট দিয়েই বলছি, মদের নেশার তাড়না কি এতটাই হয়? সত্যিই জানা নেই। এ তো মনে হচ্ছে উইথড্রয়াল সিম্পটমে ভোগা হাজার হাজার মানুষ নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করছে। করোনা যে আর কী কী দেখাবে!
দুপুর ৩.০৪
খেয়ে উঠে একটু গড়িয়ে নিয়ে অফিসে রওনা হব ভেবেছিলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। উঠে দেখছি ‘এবেলা’র প্রাক্তন সহকর্মী পৃথা একটা লম্বা হোয়াট্সঅ্যাপ পাঠিয়েছে। পড়তে পড়তে আবার দমকা হাওয়ার মতো দিনগুলো ভেসে এল।
পৃথা এখন রয়টার্সে চাকরি করে। বেঙ্গালুরুতে একা থাকে। মাঝে মাঝে কলকাতায় এলেও আমার সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু ওকে অত্যন্ত স্নেহ করি। এসেছিল স্পোর্টসে কাজ করার জন্য। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের পর নিয়েছিলাম বিনোদনী সেকশন ‘ওবেলা’র জন্য। ভুল করিনি। ফ্যাশন নিয়ে চমৎকার সব স্টোরি করত। ফ্যাশন উইক কভার করত নিয়মিত। জানতাম, ওর মধ্যে মশলা আছে। ঠিকই জানতাম। সলিড কাজের লোক না হলে রয়টার্সে চাকরি পাওয়া যায় না।
পৃথা লিখেছে, দেরিতে হলেও ‘লকডাউন ডায়েরি’ পড়তে শুরু করেছে।
‘অনেকদিন ধরেই তোমার লকডাউন ডায়েরির প্রশংসা নানা জায়গা থেকে শুনছি। এতদিন কাজের চাপে সময় পাচ্ছিলাম না। কাল সারাদিনে বেশ কয়েকটা পড়লাম। কী ইন্টারেস্টিং করে লেখো তুমি। আই হ্যাভ বিন কিপিং আ জার্নাল এভার সিন্স দ্য লকডাউন। তোমার মতো না। জাস্ট মানডেন ডেলি হ্যাপেনিংস অ্যান্ড মেন্টালি হাউ আই অ্যাম ফিলিং স্টেয়িং অল অ্যালোন অ্যামিডস্ট আ লকডাউন। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম, দিস জার্নাল ডাজন্ট সিম আইক আ জার্নালিস্ট্স অ্যাকাউন্ট। আই শুড পুট আ লিটল বিট অফ অ্যান এফর্ট টু মেক মাই রাইটিংস রিফ্লেক্ট মোর অফ দ্য সোশিও–পলিটিক্যাল ইভেন্টস দ্যাট আর আনফোল্ডিং ইচ ডে। যতই পার্সোনাল হোক, হোয়াট ইফ সামওয়ান ডিসকভার্স দিস জার্নাল মেনি ইয়ার্স লেটার আফটার মাই ডেথ। দে আর জাস্ট গোয়িং টু লাফ অ্যাট মি।
‘তোমার লেখাগুলো পড়ে খুব ইন্সপায়ার্ড হলাম। এখন মনে হচ্ছে আরেকটু যত্ন নিয়ে লিখব। যতই ব্যক্তিগত কথা লিখি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
শেষে হ্যাশট্যাগ ‘মেন্টরফরএভার’।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। বায়োস্কোপের স্লাইডের মতো ‘এবেলা’র দিনগুলো সরে সরে যাচ্ছিল। ওদের সঙ্গে প্রতিদিনের কাজ, বকাবকি, ভাল হলে পিঠ চাপড়ে দেওয়া, সেলিব্রেট করা— সব মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল, ওদের বলেছিলাম কোনও সেলিব্রটি মারা গেলে উই শুড নট মোর্ন হিজ অর হার ডেথ। রাদার উই উইল সেলিব্রেট ইট। ঋতু’দা, মান্না দে.. পরপর মৃত্যুতে আমরা ফাটিয়ে কভারেজ করেছিলাম। দেশবিদেশ থেকে বিভিন্ন লোকের লেখা যোগাড় করা, যতটা পারা যায় ঘটনার কাছাকাছি থেকে রিপোর্ট করা, টাইমলাইন, প্রয়াতদের অ্যাচিভমেন্ট। সর্বোপরি ডিজাইন এলিমেন্ট। ছবি বাছাই। সাদা–কালো ডিসপ্লে। যে কারণে ‘ওবেলা’র এন্টারটেনমেন্ট কভারেজ অতটা সাড়া ফেলেছিল। সিনেমার সমালোচনা করার সময় ওরা কাউকে রেয়াত করেনি। কারও মুখ মনে রাখেনি। কাউকে তোয়াজ করেনি। আই ওয়াজ সো সো প্রাউড অফ দেম!
কিন্তু সেসব গতজন্মের কথা। যখন মুকুল সোনার কেল্লায় থাকত। এতদিন পর এই ‘মেন্টরফরএভার’ হ্যাশট্যাগের জন্য তৈরি ছিলাম না। মনে হল যাক, তাহলে দিনগুলো বৃথা যায়নি।
দুপুর ৩.৪০
কাল কলকাতায় আসছে কেন্দ্রের জনস্বাস্থ্য প্রতিনিধিদল। গতকাল খবরটা পেয়ে পেজ ওয়ানে নিয়েছিলাম। কারণ মনে হয়েছিল, এটা কেন্দ্র–রাজ্য যুদ্ধের আরেকটা ফ্রন্ট খুলে দেবে। ঠিকই মনে হয়েছিল। আজ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন আর দীনেশ ত্রিবেদী অনলাইন প্রেস কনফারেন্স করে তীব্র ক্ষোভ জানাচ্ছেন।
ঘটনাচক্রে, দু–সপ্তাহের সফর সেরে আজই কলকাতা ছেড়ে গেল প্রথম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। যাওয়ার আগে দলের প্রধান তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ সচিব অপূর্ব চন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিবকে লেখা দীর্ঘ চিঠিতে বলেছেন, রাজ্য সরকার তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি। আরও বলেছেন, এ রাজ্যে করোনায় মৃতদের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, এ রাজ্যে শতাংশের হিসেবে মৃত ১২.৮। যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। চিঠিটা হাতে এসেছে। তাতে দেখছি লেখা, ‘এত মৃত্যু কম টেস্টিং এবং দুর্বল নজরদারির স্পষ্ট ইঙ্গিত’। চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে। বলা হয়েছে, এই প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে তাদের রিপোর্ট জমা দেবে। ফলে আরও বড় যুদ্ধ সমাসন্ন।
অবশ্য ঘটনাচক্রে, ওই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে থাকা বিএসএফের এসকর্ট গাড়ির চালক করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন!
ওদিকে গতকাল রাতে দূরদর্শনে ভাষণ দেওয়ার পর রাজ্যপাল আবার আজ মুখ্যমন্ত্রীকে একটা চার পাতার চিঠি পাঠিয়েছেন। আবার দিলীপ ঘোষও আজ মুখ্যমন্ত্রীকে একটা চিঠি লিখেছেন। তাঁদের চিঠির টোন এবং ভাষা কী হতে পারে, তা এতদিনে সকলে জেনে গিয়েছেন। তাই এই ডায়েরিতে বিস্তারে গেলাম না। কিন্তু এটা ক্রমশই একটা বোকা–বোকা জায়গায় পৌঁছচ্ছে।
সন্ধ্যা ৬.০০
মুখ্যসচিব নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে জানাচ্ছেন, রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত এখনও পর্যন্ত ৬১ জন। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৬১ জন। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১,২৫৯। সংক্রমণ–মুক্ত ২১৮ জন।
কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের চিঠি নিয়ে প্রশ্ন শুনে তিনি বললেন, ‘যতবারই ওঁরা আমায় চিঠি লেখেন, দেখেছি তার ঘন্টাদুয়েক আগে সেটা আপনাদের কাছে পৌঁছে যায়।’
সন্ধ্যা ৬.২৮
ইস্ট দিল্লির সব লিকার শপ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে দিল্লি পুলিশ। এটাই হওয়ার ছিল। দোকান খোলামাত্রই হাঘরের মতো গিয়ে হামলে পড়লে এই–ই হয়। অনেকদিন আগে এক বর্ষীয়ান মাতালের আপ্তবাক্য মনে পড়ে গেল। অফিসের গেট টুগেদারে এক সহকর্মী মদ খেয়ে বেহদ্দ মাতাল হয়ে বমি–টমি করে ছড়িয়ে ফেলেছিল। সেদিন কোনওমতে তাকে অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। দু’দিন বাড়িতে থেকে ধাতস্থ হয়ে জয়েন করার পর সিনিয়র সহকর্মী বলেছিলেন, ‘আরাম সে পিও বেটা। সারি জিন্দেগি পিনা হ্যায়। হ্যায় কি নহি? তো বরখুরদার, যব ভি পিও, আরাম সে পিও।’
এঁরা সব নমস্য ব্যক্তি। আজকাল আর এঁদের দেখা পাওয়া যায় না। মদ্যপদেরও জাত গিয়াছে।
সন্ধ্যা ৭.৪২
মিঠু ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছে ‘অর্থনীতি চাঙ্গা করা এখন মাতালদের দায়িত্ব। ওদের সম্মান করতে শিখুন’। দেখে ভাল লাগল যে, এই কঠিন সময়েও আমার বাল্যবন্ধু আত্মসম্মানজ্ঞানটা টনটনে রেখেছে। ওর সেন্স অফ হিউমার চিরকালীন। সঙ্কটসময়ে সেটা না হারানো দৃষ্টান্তযোগ্য।
রাত ৮.৩২
পশ্চিমবঙ্গে কনটেনমেন্ট জোন বেড়ে হল ৫১৬টি। এর মধ্যে কলকাতায় ২৬৪টি থেকে বেড়ে কনটেনমেন্ট জোনের সংখ্যা হয়েছে ৩১৮টি। উত্তর ২৪ পরগনায় কনটেনমেন্ট জোন ৮১টি, হাওড়ায় ৭৪টি, হুগলিতে ১৮টি, নদিয়ায় ২টি, পূর্ব মেদিনীপুরে ৯টি, পশ্চিম মেদিনীপুরে ৫টি, পূর্ব বর্ধমানে ১টি, মালদায় ৩টি, দার্জিলিংয়ে ২টি, কালিম্পংয়ে ১টি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ১টি। রাজ্যের বাকি ৯টি জেলায় কোনও কনটেনমেন্ট জোন নেই।
এইসমস্ত জোনে কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেওয়া হবে না। এটা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে এখন আর রেড, অরেঞ্জ বা গ্রিন জোন নেই। এখন জোন শুধু একটাই— কনটেনমেন্ট জোন।
১০.৩৩
লকডাউনে আরও একটা দিন কাটল। প্রায় রোজই ঘুমোতে যাই জীবনের বিভিন্ন গ্লানি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে। আজ শোওয়ার সময় বেডসাইড টেবিলে হলদে আলোর পাশে এই অকিঞ্চিৎকর জীবনের উজ্জ্বল প্রাপ্তি সযত্নে রেখে দিলাম।
#মেন্টরফরএভার
Dada darun laglo.
LikeLike
thank you very much
LikeLike