
০১.০৫.২০২০। শুক্রবার
সকাল ৮.২১
নাহ্, নাসিরুদ্দিন শাহের স্টোরিটা মিস্ করিনি। অ্যাকচুয়্যালি নাসিরুদ্দিন শাহের স্টোরিটা হয়ইনি। কাল গভীর রাতে রাজা একটা লিঙ্ক পাঠাল। খুলে দেখলাম, নাসিরের ছেলে ভিভান টুইট করেছে রাত ৯টা ২১ মিনিটে— ‘অল ওয়েল এভরিওয়ান। বাবা ইজ জাস্ট ফাইন। ওঁর শরীর নিয়ে যাবতীয় গুজব মিথ্যে। উনি ভাল আছেন। প্রেয়িং ফর ইরফানভাই অ্যান্ড চিন্টুজি। মিসিং দেম আ লট। ওঁদের পরিবারের জন্য গভীর সমবেদনা রইল। ইট্স আ ডেভাস্টেটিং লস ফর অল অফ আস’।
নাসির নিজেও ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যারা আমার স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে, তাদের ধন্যবাদ। আমি ভাল আছি। বাড়িতেই লকডাউনে আছি। দয়া করে কোনও গুজবে বিশ্বাস করবেন না’।
পড়তে পড়তে কাল রাতে আরেকটা হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে পাঠানো কোনও এক হিন্দি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজের একটা স্ক্রিনশট দেখছিলাম। বড় বড় করে লেখা, নাসিরুদ্দিন শাহ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। মনে হচ্ছিল, এদের কী অসম্ভব সাহস! জার্নালিজমের বেসিকটাই জানে না। অথচ বুক ফুলিয়ে বাজারে নেমে পড়েছে! এরা এটুকুও জানে না যে, একটা খবর আপলোড করার আগে কমসে কম পাঁচবার চেক করা উচিত। আর এমন একটা সেনসিটিভ সময়ে এত সেনসিটিভ খবর আপলোড করার সময় অন্তত দশবার।
জার্নালিজমের যে ইউনিভার্সিটিতে ১৯৯০ সালে আমার শিক্ষানবিশি শুরু হয়েছিল, সেখানে একটা কথা মন্ত্রের মতো শেখানো হতো— বেটার অমিট দ্যান কমিট। না জানলে লেখার দরকার নেই। জগতে সবকিছু জানা সম্ভবও নয়। কিন্তু ভুল লিখে ক্রেডিবিলিটি নষ্ট কোর না। ওটা গড়তে অনেক সময় লাগে। আমি এখনও সেই ওল্ড স্কুলিংয়ে বিশ্বাস করি। আজীবন করব। এই শিক্ষার মার নেই।
দীর্ঘদিন খবরের কাগজে কাজ করতে করতে মাঝেমাঝেই অডিও ভিস্যুয়ালকে হিংসে হয়েছে। মনে হয়েছে, একটা খবর ভুল হলে ওরা সেটা পাঁচমিনিটের মধ্যে হুইল থেকে তুলে নিতে পারে। কিন্তু কাগজে ছাপা হয়ে গেলে সেটা চিরতরে ডকুমেন্টেড হয়ে গেল! যেমন ধনুক থেকে তির, টিউব থেকে টুথপেস্ট আর মোবাইল থেকে টেক্সট মেসেজ একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত নেওয়া যায় না। ইদানীং অবশ্য হোয়াট্সঅ্যাপ মেসেজে গুবলেট হলে বা ভুল উইন্ডোয় পাঠালে সেটা তৎক্ষণাৎ ডিলিট করা যায়।
আবার পাশাপাশিই জানি এবং মানি যে, অডিও ভিস্যুয়ালের সহকর্মীদের কাজটা অনেক, অনেক বেশি কঠিন। খাটনি অনেক বেশি। ফোনে ফোনে মারার উপায় নেই। স্পটে যেতে হয়। এবং সবচেয়ে বড় কথা— এই দুর্মর প্রতিযোগিতার বাজারে চকিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ, কে আগে স্টোরিটা ব্রেক করবে তার উপর চ্যানেলের টিআরপি নির্ভর করে। রিপোর্টারের ভবিষ্যৎও। খবরের কাগজের মতো সারাদিন ধরে জাবর কেটে সন্ধ্যাবেলা দু’ছত্র লিখে দেওয়ার বিলাসিতা সেখানে নেই।
নাসিরের খবরটা যেমন ভুল ছিল, ধরে নিচ্ছি মিঠুন’দার অসুস্থ হয়ে হসপিটালাইজ্ড হওয়ার খবরটাও ডাহা গুল।
সকাল ৮.৫৪
রোদ্দূর রায়ের মেসেজ, ‘হ্যালো! হাউ আ ইউ ডুইং স্যার?’
লিখলাম, অ্যাম গুড। হাউ অ্যাবাউট ইউ?
তার আর জবাব আসেনি। বোধহয় মেসেজ পাঠিয়ে গাঁজা–টাজা খেয়ে আবার সমাধিস্থ হয়ে পড়েছে। যেটা ইন্টারেস্টিং, এবার শুধু ‘হ্যালো’ লিখেছে। ‘মোক্সাহ্যালো’ নয়। তাহলে কি ওর আর মোক্ষের দরকার নেই? নাকি মোক্ষলাভ হয়ে গিয়েছে অলরেডি?
বেলা ১১.২০
অমিতাভ বচ্চন তাঁর ব্লগে ঋষি কাপুরকে নিয়ে লিখেছেন। যা লিখেছেন, তার কিছু কিছু ঋষির আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম। যা জানতাম না, ঋষি নাকি সেটে শট নিতে দেরি হলে পকেট থেকে তাস বা ব্যাগ থেকে ব্যাগাটেলি বোর্ড বার করে লোকজনকে ডেকে খেলতে বসে যেতেন। এবং সে খেলা স্রেফ টাইমপাস নয়। সিরিয়াস চ্যালেঞ্জের খেলা। সেখানে জেতা–হারাকে যথেষ্ট মূল্য দিতেন তিনি।
একেবারে শেষে অমিতাভ লিখেছেন, ‘অসুখ ধরা পড়া এবং চিকিৎসা চলার সময় একবারও আফশোস করেনি। সবসময় বলত, সি ইউ সুন। জাস্ট আ রুটিন ভিজিট টু দ্য হসপিটাল। আই উইল বি ব্যাক শর্টলি। আমি কখনও ওকে হাসপাতালে দেখতে যাইনি। কারণ, ওর ওই অসামান্য সুন্দর দেবদূতের মতো মুখে যন্ত্রণার ছাপ দেখতে পারতাম না। আমি নিশ্চিত, যাওয়ার সময়েও ও হাসিমুখেই গিয়েছে’।
‘দূরদর্শনইন্ডিয়া’ টুইট করেছে, রামায়ণের রিপিট টেলিকাস্ট সারা পৃথিবীতে ভিউয়ারশিপে রেকর্ড তৈরি করেছে। গত ১৬ এপ্রিল মোট ৭.৭ কোটি লোক রামায়ণ দেখেছে। ওরে বাবা!
একটু আগে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম চারদিকে প্রচুর রং–বেরঙের প্রজাপতি উড়ছে। কালো চকচকে রাস্তা চিরে দৌড়চ্ছে কাঠবেড়ালি। গাছের পাতায় ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। ওই লাইনগুলো মনে এল—
‘ফড়িংয়ের ডানাতেও
এ জীবন দেয় ডাক।
বেঁচে থাক সব্বাই
হাতে হাত রাখা থাক।’
বেলা ১১.৩৬
দিল্লি থেকে স্যমন্তক ফোন করল। রবিবার রবিবার ও একটা ফিচার লিখত। ‘এবেলার সঙ্গে চা’। আইডিয়াটা ছিল বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের সঙ্গে চা খেতে খেতে আড্ডা। গতকাল রাতে চুনী গোস্বামীকে নিয়ে লেখাটা ফেসবুকে শেয়ার করেছিল দেবমাল্য। সঙ্গে সুমিত্রর আঁকা চুনী’দার ছবি। স্যমন্তক বলল, ‘ওটা দেখার পর থেকে খুব মন খারাপ লাগছে এবেলার জন্য। কী একটা টিম ছিল আমাদের! সুমিত্রর কথাও খুব মনে পড়ছিল। তাই তোমায় ফোন করলাম।’
বলল, কিছুদিন ধরে জার্মানির মাইন্জ ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছে। ওদের একটা প্রজেক্টে শুরু হয়েছে। যেখানে ওরা বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্ট করা শুরু করেছে। স্যমন্তক সেই সাংবাদিকদের একজন। মূলত স্কাইপে ইন্টারঅ্যাকশন। আলোচনার মোদ্দা বিষয়: এই মুহূর্তে অল্টারনেটিভ জার্নালিজম কী এবং এখন সারা পৃথিবী ও ভারতে মেনস্ট্রিম সাংবাদিকতার গ্রহণযোগ্যতার পথে মূল সমস্যাগুলো। কীভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আর মেনস্ট্রিম জার্নালিজমের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। রিফিউজি ক্রাইসিস। ভারতীয় উপমহাদেশের শরণার্থী ইতিহাস আর ইউরোপে নতুন করে তৈরি হওয়া ক্রাইসিস।
শুনে খুব গর্ব হল প্রাক্তন সহকর্মীর জন্য।
আবার মনে পড়ে গেল সুমিত্রর কথা। ও ছিল ‘এবেলা’র প্রাণ। আমি চারবছর ছুটি নিইনি। ও–ও নেয়নি। প্রথম পাতায় প্রতিদিন কী সমস্ত ইলাস্ট্রেশন করেছে! ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি ভোরে ও বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ততদিনে আমি ‘এবেলা’ ছেড়ে এসেছি। সুমিত্র খুব স্বস্তিতে ছিল না বলেই খবর পেতাম। কিন্তু নিজে থেকে কোনওদিন আমায় কিছু বলেনি। মুখচোরা, অভিমানী শিল্পীরা যেমন হয়। মৃত্যুর খবর পেয়ে গিয়েছিলাম ওর গড়িয়ার বাড়িতে। তখন ওর দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে। ওর স্ত্রী বলেছিল, ‘ও তো আপনার সব কথা শুনত অনিন্দ্যদা। আপনি বললে ও ঠিক ফিরে আসবে। আপনি কেন ওকে একবার ডেকে পাঠাচ্ছেন না?’
কিছু বলতে পারিনি। একরকম পালিয়েই এসেছিলাম। সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম বোড়াল শ্মশানে। ততক্ষণে সুমিত্রর দেহ চুল্লিতে ঢুকে গিয়েছে। কিছুক্ষণ একা একাই দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর চলে এলাম।
আর কোনওদিন যাইনি। ওর স্ত্রীয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করিনি। কী বলতাম? কিন্তু ওই তরুণী সদ্যবিধবার প্রশ্নটা এখনও আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আর মনে হয়, যারা ওর মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে দায়ী রইল, তাদের কিছু হল না। তারা সকলে দিব্যি আছে।
তারা দিব্যিই থাকে।
বেলা ১১.৫০
ডাক্তার ব্যানার্জিকে ফোন করলাম। স্বার্থের ফোন। উনি আমার বাচ্চাদের ডাক্তার। অ্যান্ড হি হ্যাজ অলওয়েজ বিন মাই গো টু ম্যান। আপাতত বেলঘরিয়ার রেড জোনে বন্দি। ওঁকে আমি ধন্বন্তরি মানি। ইনস্টুর শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে হঠাৎ। একটু অ্যাডভাইস দরকার ছিল।
আজ অফিস ছুটি। অতএব পরিপূর্ণ ল্যাদ খাওয়ার দিন। কিন্তু ল্যাদ খেলে চলবে না। ইএমআই–এর চেকটা আজ ফাঁকায় ফাঁকায় যোধপুর পার্কের ব্যাঙ্কের ড্রপ বক্সে ফেলে আসি। অবশ্য এখন তো রোজই ফাঁকা দিন। ফাঁকা রাত।
দুপুর ১২.০৮
ওহ্, ঋষি কাপুরের ভিডিওটা সত্যিই তাঁর মৃত্যুর আগের রাতে তোলা নয়। এটা কাল রাতেই ফেসবুকের ওয়ালে লিখেছিলেন শান্তনু সেনগুপ্ত। তখনই শুধরে দিয়েছিলাম। আজ দেখছি, নিজের সংস্থার করা সেই খবরকে নিজেই প্রকাশ্যে ভুল বলে ঘোষণা করেছেন ইন্ডিয়া টুডে টিভি–র রাহুল কানওয়াল। বলেছেন, ভিডিওটা গত ফেব্রুয়ারিতে তোলা। আর যিনি গান গাইছেন, তিনি ধীরজ নামে এক ওয়ার্ডবয়। কোনও চিকিৎসক নন।
রাহুলকে আমার এমনিতে খুবই পাকা বলে মনে হয়। অনেকে ওকে নিয়ে খিল্লিও করে। ওর এই টুইটের পরেও করবে। ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলকেও ছ্যা–ছ্যা করবে। কিন্তু নিজের ভুল স্বীকার করতে বুকের পাটা লাগে। বরাবর নিজে এই নীতিতে বিশ্বাস করে এসেছি। কাজ করতে গেলে ভুল হয়। সেটা স্বীকার করার মধ্যে কোনও পরাজয় বা মালিন্য নেই। বরং সৎসাহস আছে। তবে সেটার জন্য বুকের খাঁচা নিয়ে জন্মাতে হয়। যে কলজেতে একটা নীতি এবং ন্যায়নিষ্ঠতা থাকে। সকলের, ইন ফ্যাক্ট বেশিরভাগেরই সে কলজে থাকে না। বা থাকলেও আমার চোখে পড়ে না।
দুপুর ১২.৩০
ইরফান খানের স্ত্রী সুতপা শিকদারের লেখা একটা দীর্ঘ পোস্ট ফেসবুকে ঘুরছে। তিনি লিখছেন—
‘একে কীভাবে পারিবারিক বিবৃতি বলি, যখন সারা দুনিয়া এই ঘটনাকে তাদের ব্যক্তিগত ক্ষতি বলে ভাবছে?… সকলকে বলতে চাই, এটা ক্ষতি নয়। আসলে এটা লাভ। কারণ, ওর শিক্ষাটা আমরা এখন ফলিত স্তরে প্রয়োগ করতে পারব’।
দীর্ঘ পোস্টে সুতপা আরও লিখছেন, ‘ইরফানকে নিয়ে আমার একটাই ক্ষোভ। ও আমাকে সারা জীবনের মতো স্পয়েল্ট করে দিয়েছে। পারফেকশনের জন্য ওর খুঁতখুঁতুনি আমায় আর এখন সাধারণ কিছুতে সন্তুষ্ট হতে দেয় না।… যেমন চিকিৎসকের রিপোর্ট আমার কাছে ছিল ওর অভিনয়ের চিত্রনাট্যের মতো। যেখানে আমি সামান্যতম ডিটেলও মিস্ করতে চাইতাম না। আমাদের জীবনে অবাঞ্ছিত অতিথির আগমনের পর ওর মতোই আমি ক্যাকোফনির মধ্যে হারমনি খোঁজার চেষ্টা করেছি। ওর মতোই জীবনের দোলাচলে ছন্দ খোঁজার চেষ্টা করেছি।
‘গত আড়াই বছর সময়টাকে আমাদের যাত্রাপথে আমি একটা ইন্টারল্যুড হিসেবে দেখি। যে যাত্রার একটা শুরু ছিল। একটা মধ্য ছিল। একটা অন্তও ছিল। ওই ইন্টারল্যুডে ইরফানের ভূমিকা ছিল অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরের। যা আমাদের ৩৫ বছরের যৌথযাপন এবং সাহচর্যের থেকে আলাদা। আওয়ার্স ওয়াজ নট আ ম্যারেজ। ইট ওয়াজ আ ইউনিয়ন।
‘আমাদের ছোট পরিবারকে বরাবর একটা নৌকোর মতো দেখেছি। যেখানে বাবিল আর আয়ান বৈঠা নিয়ে দাঁড় বাইছে আর ইরফান ওদের গাউড করছে, ‘এদিকে যাও। ওদিকে মোড়ো।’ কিন্তু জীবনটা তো আর সিনেমা নয়। সেখানে কোনও রিটেক নেই। আশা করি, ভবিষ্যতেও ইরফানের পরামর্শ অনুযায়ীই বাবিল–আয়ান যাবতীয় ঝড়ঝাপ্টা সামলে নৌকোটা এগিয়ে নিয়ে যাবে।
‘আমি ওদের বলেছিলাম, ওরা কি ওদের বাবার দেওয়া ইম্পর্ট্যান্ট শিক্ষা এককথায় বলতে পারবে?
বাবিল বলল, ‘লার্ন টু সারেন্ডার টু দ্য ডান্স অফ আনসার্টেনটি অ্যান্ড ট্রাস্ট ইওর ফেথ ইন দ্য ইউনিভার্স।’
আয়ান বলল, ‘লার্ন টু কন্ট্রোল ইওর মাইন্ড অ্যান্ড টু নট লেট ইট কন্ট্রোল ইউ।’
৩৫ বছরের সঙ্গী চলে যাওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে এই কমপোজার শেখার মতো। শোক আত্মস্থ হতে সাধারণত সময় নেয়। প্রার্থনা করব, জীবনের বাকি দিনগুলোতেও সুতপা এই শক্তি অটুট রাখতে পারবেন।
দুপুর ২.৩০
যোধপুর পার্কের ফুটপাথে ব্যাঙ্কের ড্রপবক্সে চেক ফেলে কালিকাপুরের পেট্রল পাম্পে তেল নিতে গিয়েছিলাম। খাঁ খাঁ করছে গোটা এলাকা। পাম্পের ক’জন কর্মী বসে নিজেদের মধ্যে গজল্লা করছিলেন। এই পাম্পটা সারা রাত খোলা থাকত। এখনও কি তা–ই থাকে? মাথায় টুপি, থুতনিতে হাল্কা নূরের এক বয়স্ক কর্মী বললেন, ‘হ্যাঁ থাকে। তবে গাড়ি–টাড়ি আসে না। দিনেরবেলাতেও এখন মাত্র সাত–আটটা গাড়ি আসে।’
— আগে কত আসত?
‘প্রচুর! প্রচুর! এই একটা মেশিন থেকে দিনে তিন–চার লাখ টাকার সেল হতো। এখন সারা দিনে মেরেকেটে ১০ হাজার টাকার তেল বিক্রি হয়। আচ্ছা, এই লকডাউন কতদিন চলবে?’
— অনেকদিন। অন্তত মে মাসটা তো বটেই। তেমনই মনে হচ্ছে এখন।
কর্মীরাই বললেন গাড়ির চাকার হাওয়া চেক করিয়ে নিতে। মনে হল, তাঁরা চাইছেন আরও একটুক্ষণ থাকি। আরও একটুক্ষণ প্রাণের সাড়া থাকুক নিঝুম পরিপার্শ্বে। কিছু বকম বকম হোক।
ভাগ্যিস চেয়েছিলেন। হাওয়া পরীক্ষা করাতে গিয়ে ধরা পড়ল, পিছনের বাঁদিকের টায়ারে একটা লিক আছে। মুস্তাক বলে এক তরুণ অভিজ্ঞ চোখে ধরলেন। তিনমিনিটে সারিয়েও দিলেন। রাখে মুস্তাক, মারে কে! দুপুর থেকে যে দুর্যোগ শুরু হয়েছে, তা আরও অন্তত দু’দিন চলবে বলেই খবর। রাস্তায় গাড়ি বসে গেলে কী করতাম! ফোন নম্বর নিয়ে রাখলাম মুস্তাকের। লকডাউনের এই দুনিয়ায় এসব খাপ খুলে রাখা খুব জরুরি।
সন্ধ্যা ৬.৪৬
সারা দেশে লকডাউন সেই বাড়ল। আপাতত ১৭ মে পর্যন্ত। আপাতত। কারণ, ব্যক্তিগত ধারনা ওটা অন্তত মে মাসের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে। সল্টলেকের বাড়িতে যেদিন থেকে থাকতে শুরু করলাম, সেদিনই মনে হয়েছিল, এটা মে মাস শেষ পর্যন্ত টানবে।
অর্থাৎ ১৭ মে পর্যন্ত যাত্রীবাহী বিমান, যাত্রীবাহী রেল, মেট্র, আন্তঃরাজ্য সড়ক পরিবহণ বন্ধ। বন্ধ স্কুল কলেজ সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এবং এই নির্দেশ রেড, অরেঞ্জ, গ্রিন সমস্ত জোনেই প্রযোজ্য। গ্রিন ও অরেঞ্জ জোনে শর্তসাপেক্ষে মদের দোকান খোলা যাবে বলে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র।এই দুই জোনে নিশ্চয়ই খুশির হাওয়া।তবে, সমস্যা হল নির্দেশে বলা হয়েছে একটি দোকানে একই সময়ে পাঁচজনের বেশি থাকা যাবে না। আর পরস্পরের মধ্যে ছ’ফুট দূরত্ব রাখতে হবে। কিন্তু পিপাসুদের কি এত নিয়মের নিগড়ে বেঁধে রাখা যাবে ? নিশ্চয়ই এতদিনে অনেকের শরীরে অ্যালকোহলের মাত্রা এত কমেছে যে, প্রায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ড্রিপ দেওয়ার মতো অবস্থা ! তাঁদের কি এত ধৈর্য সইবে?
সন্ধ্যা ৭.২৪
টিং করে একটা হোয়াট্সঅ্যাপ নোটিফিকেশন ঢুকল। খুলে দেখলাম রূপঙ্কর একটা গান পাঠিয়েছেন। ‘বিষন্ন গোলাপ’। উনি এবং উজ্জয়িনী গেয়েছেন। ভিডিও–টা সাদা–কালোয় শ্যুট করা। গানটা শুনে ভাল লাগল। তবে ভিডিও–তে রূপঙ্কর–উজ্জয়িনীর মুখ অর্ধেক অর্ধেক জুড়ে একটা কান্ড করা হয়েছে। ওটা আমার খুব একটা পোষাল না।
সন্ধ্যা ৭.৫১
ফেসবুকে দেখছি সকন্যা ন্যাড়া হয়েছে সহকর্মী নজরুল। ওর স্ত্রী–র হাতযশ। এটা কিন্তু জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছে! আমাকেও এই দুঃসাহসিক কাজটা করতে হতে পারে। কিন্তু আমাকে কি ওর মতো হ্যান্ডসাম লাগবে? দ্বিতীয়ত, সেলুনের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তাতে কি ভবিষ্যতে চারদিকে প্রচুর ন্যাড়ামুন্ডি দেখা যাবে?
রাত ৮.০১
সন্তোষ’দা ফোন করলেন। সন্তোষ সাহা। নরেন্দ্রপুরের শিক্ষক। ওঁর সঙ্গে আমার খানিকটা অনিয়মিত হলেও যোগাযোগ আছে। ওঁর কন্যার বিবাহেও গিয়েছিলাম। সন্তোষ’দার ফোনে স্মৃতির দরজা–জানালাগুলো ঝপ ঝপ করে খুলে গেল। প্রেয়ারহলে প্রেয়ার চাদর মুখে দিয়ে হাসার জন্য নরেন্দ্রপুরের ছ’বছরের জীবনে মাত্র একবার বেত খেয়েছিলাম। তা–ও সন্তোষ’দার হাতেই।
উনি আমার ছোটবেলার হিরো। ফ্যান্টাস্টিক ফুটবল আর ভলি খেলতেন। উনি নেটে খেলতেন আর আমি মিড্লম্যান। নেটে বল তুলতাম আর সন্তোষ’দা ফাটিয়ে স্ম্যাশ করতেন। তেমনই স্মার্ট ছিলেন। ছিপছিপে চেহারা। মুর্শিদাবাদের মানুষ। জুনিয়র সেকশনের হস্টেলে থাকতেন ওয়ার্ডেন হিসেবে। সন্তোষ’দাকে ভালবাসতাম। কিন্তু ভয়ও পেতাম। ডানহাতে মেটাল স্ট্র্যাপের ঘড়ি পরতেন। ওই হাতেই মারতেন। মারার আগে ঘড়িটা খুলে নিতেন। পাছে ছাত্রের গা–হাত–পা কেটে যায়। সন্তোষ’দা কাউকে ‘অ্যাই এদিকে আয়’ বলে ডেকে ঘড়ি খুলছেন দেখলে প্রমাদ গুনতাম।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা তীব্র হিরো ওয়ারশিপ ছিল। আগে শুধু গোঁফ ছিল। পরে দাড়ি রাখতে শুরু করে আরও হ্যান্ডসাম হয়ে গেলেন। একদিকের ভুরু উপরে তুলে প্রশ্ন করতেন। যেটা পরবর্তীকালে শ্রীদেবী আর মাধুরী দীক্ষিত ছাড়া কাউকে করতে দেখিনি।
এখন সন্তোষ’দা ৭০। স্ত্রীয়ের হাঁটু অপারেশন হয়েছে বলে নিজেই বাড়ির সব কাজ করছেন। তার মধ্যেও ফোন করে পুরোন ছাত্রের খোঁজ নিচ্ছেন। বললেন, ‘তুই আমার মনের ভিতরে থাকিস। তোকে আমি কোনওদিন ভুলব না।’ চোখে জল এল। কোনও প্রয়োজনে ফোন করেননি। অথচ আমার তো এই সময়টায় ওঁর কথা মনে পড়েনি! এতদিন কেটে গেল! ঘোর লজ্জা হল।
রাত ১০.১০
আজ সারাদিন ইংলিশ ওয়েদার। হলদে ফুলের চাদরে রাস্তাঘাট বিদেশের মতো লাগছে। ঠাণ্ডা এক মাতলা হাওয়া বইছে।এবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হল—
‘বেঁচে থাক সব্বাই
হাতে হাত রাখা থাক।’
একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম নাসিরউদ্দিনজি ও মিঠুন চক্রবর্তী কে নিয়ে….। যাক চিন্তা কাটল। সুতপা শিকদার এর লেখা টা পড়তে পড়তে মনে হল অত্যন্ত পরিণত মনে র মহিলা। আপনি এ ব্যাপারে আলোকপাত করলেন বলে ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
LikeLike
ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
LikeLike
অসাধারণ লিখে চলেছেন অনিন্দ্য দা…আপনার প্রতিটি এন্ট্রি খোলা চিঠি থেকে লকডাউনের ডায়েরি, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ি, অবাক হয়ে পড়ি, তুমি কেমন করে লেখো হে গুণী।
মানবোত্তম, পুরুলিয়া
LikeLike
ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।
LikeLike
আপনি এত সুন্দর লেখেন, একবার পড়া শুরু করার পর অভ্যাসের মতন হয়ে গেছে। মুগ্ধ!
LikeLike
ধন্যবাদ। 🙂
LikeLike