
২৯.০৪.২০২০। বুধবার
বেলা ১১.০০
এখন আর সকালগুলো ফাঁকা থাকে না। ওয়ার্ক আউট কচ্ছি কিনা! সকালে উঠে বাবা–মা’কে চা দিয়ে, নিজে চা–বিস্কুট খেয়ে হাল্কা গড়িয়ে ৯টা থেকে গান চালিয়ে শুরু করে দিই।
১০টা পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়ে আজ গেলাম নীচতলাটা ‘মপ’ করতে। বাসন্তী’দিকে আপাতত আসতে বারণ করেছি। সল্টলেকের করুণাময়ী রেড জোনে আছে। অতএব, ‘করোনাময়ী’। বাসন্তী’দি থাকে বিকাশ ভবনের কাছে। করুণাময়ী থেকে খুব দূরে নয়। সময়টা খারাপ। সাবধানের মার নেই। এখন আমিই সামলে দিতে পারব মনে হচ্ছে। আজই যেমন ডেটল আর ফিনাইল দিয়ে নীচটা ভাল করে মপ করেছি। ভাবছিলাম, উপরে এসে ডায়েরিটা লিখব। কিন্তু ততক্ষণে ঘাম শুকিয়ে আবার রাক্ষসের মতো খিদেটা চলে এসেছে। আর খালি পেটে যেমন ধর্ম হয় না, তেমনই লকডাউন ডায়েরিও লেখা হয় না। ফলে হাল্কা মাখমে সাঁতলে দ্রুত ৪ স্লাইস মাল্টিগ্রেন ব্রেড আর এক বাটি ডালসেদ্ধ খেয়ে ফেললাম। ব্লিস, ব্লিস।
সকাল থেকে বহির্জগতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বহুকিছু ঘটে গিয়েছে বাইরের পৃথিবীতে! একটু কুনো এবং সংযোগ–বিচ্ছিন্ন লাগছে। এটা খুব হতো বাইরে অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে। হোটেলের ঘরে ঘুম ভেঙে উঠে প্রথমেই মনে হতো, আরে যাহ্, আমি তো কোনও খবরই জানি না! বাইরের পৃথিবীতে নিশ্চয়ই ধুন্ধুমার শুরু হয়ে গিয়েছে। এটা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল একবার মুম্বইয়ে গিয়ে। যখন ব্যালাড এস্টেটের একটা গথিক স্থাপত্যের হোটেলে উঠেছিলাম।
সেই নিরিবিলি ব্যালাড এস্টেট, যেখানে বহু হিন্দি ছবির বিখ্যাত দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছে। ‘দিওয়ার’–এ যেখানে ভাই শশী কাপুরের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন অমিতাভ। আর তাঁর পকেট থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়েছিল পয়মন্ত ‘৭৮৬’ লেখা বিল্লা। হাঁকুপাঁকু করেও যা তিনি উদ্ধার করতে পারেননি। তার কিছু পরেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়বেন তিনি।
অথবা ‘মশাল’। যেখানে এই ব্যালাড এস্টেটের রাস্তায় মৃতপ্রায় ওয়াহিদা রহমানকে নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন তাঁর প্রৌঢ় স্বামী দিলীপ কুমার। পথচলতি গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়তে দৌড়তে আকুল হয়ে বলছিলেন, ‘সাব রুকিয়ে। মেরি বিবি মর রহি হ্যায়। রুকিয়ে সাব। অস্পাতাল (হাসপাতাল) পঁহছা দিজিয়ে। আপকে বাচ্চেঁ জিয়ে।’
ব্যালাড এস্টেট তখনও নিরিবিলি। রোজ সকালে ঘুম ভেঙে মনে হত, একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে রয়েছি। দ্রুত ফোন ঘোরাতে শুরু করতাম। আজ যেমন টিভি–র চ্যানেল ঘোরাতে শুরু করলাম।
বেলা ১১.২৩
ওহ্, আজ সকালে একটা মজা হয়েছে। ওয়ার্ক আউট শুরুর আগে বারান্দার রেলিং ধরে স্ট্রেচ করছিলাম। পাশের বাড়ির বাসিন্দা ভদ্রমহিলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলেন। হাতে একটা সাজি। উনি রোজই অন্যান্য বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির বাগান থেকেও টগরফুল তুলে নিয়ে যান। কিন্তু আজ একেবারে ফুলগাছের মালিকের মুখোমুখি। মাস্কের আড়াল থেকে দোতলার দিকে চোখ তুলে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘একটু ফুল নেব?’
— একটু কেন। সব নিয়ে যান।
ভদ্রমহিলা একটু থমকালেন। ভাবলেন বোধহয় কটাক্ষ করছি। সেটা বুঝে আবার বললাম, সব নিয়ে যান। কারও না কারও তো কাজে লাগবে।
ভদ্রমহিলা খুশি হলেন। বিপুল উৎসাহে ফুল তুলতে শুরু করলেন। আর আমি মনে মনে বললাম, আপনাদের বাড়ির আমগাছটা সম্পর্কেও যদি আমাকে কেউ এটা বলত! সব নিয়ে যান। কারও না কারও তো কাজে লাগবে। নইলে তো গাছে থেকে থেকেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাহলে আর রোদ–বৃষ্টির মধ্যে ছাদে ঘুরে ঘুরে ঝরে–পড়া আম কুড়োতে হতো না। দিব্যি টুকটুক করে হাত বাড়িয়ে বারান্দা থেকে পেড়ে নিতে পারতাম। টগরফুলের মতো।
কিন্তু কে না জানে, এসবই স্বপ্নবিলাস। দীর্ঘশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস।
দুপুর ১২.০৩
দেশের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মহারাষ্ট্র। আক্রান্ত ৯ হাজারের উপর। মৃত ৪০০ প্লাস। ভারতে এখন আক্রান্ত ৩১ হাজার। মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেল। রাজ্যে করোনায় মৃত বেড়ে ২২। তবে এর মধ্যে কো–মর্বিডিটি ধরা নেই।
সারা পৃথিবীতে মৃত ২ লাখ ১৭ হাজার। তার মধ্যে আমেরিকাতেই মৃত প্রায় ৬০ হাজার। ইতালিতে ২৭ হাজারের বেশি। স্পেনে ২৩ হাজারের বেশি।
টিকিয়াপাড়ায় পুলিশের উপর হামলার ঘটনায় কাল গভীর রাতে ১৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। সেটা জেনে একটা চিন্তা মাথায় এল। আচ্ছা, এখন তো মাস অ্যারেস্টও করা যাবে না। লক–আপে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনটেন করা হবে কী করে? চিন্তার বিষয়।
ওরে নাহ্, করোনা রুখতে কলকাতা শহরে যজ্ঞ করেছেন তৃণমূলের এক কাউন্সিলার। নাম ‘করোনা বিনাশী যজ্ঞ’। ভাবা যায় না! গোমূত্রের নিদানের পর এবার যজ্ঞ। যজ্ঞস্থলে পোস্টারও পড়েছে। ‘করোনা মুক্তি যজ্ঞ’। টিভি–তে দেখাচ্ছে, সবুজ রংয়ের মাস্কের আড়াল দিয়ে কাউন্সিলার বলছেন, তাঁরা হিন্দু ধর্মমতে বিশ্বাসী। তাই করোনাকে তাড়াতে যজ্ঞ করছেন। তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা শান্তনু সেন অবশ্য নিন্দা করেছেন।
এবার বাইপাসের ডিসান হাসপাতালও ‘করোনা হাসপাতাল’ হল।
দুপুর ১২.১৭
ইরফান খান নেই?
মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালের আইসিইউ–তে ভর্তি ছিলেন। গত রবিবার জয়পুরে ইরফানের মা মারা গিয়েছেন। অসুস্থতা এবং লকডাউনের জন্য সেখানে যেতে পারেননি ক্যান্সার সারভাইভার ইরফান। দু’বছর আগে তাঁর কোলনে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ইংল্যান্ডে চিকিৎসা হয়েছিল। শোনা যাচ্ছিল, ইরফান খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠছেন। মুম্বইয়ে ফিরে এসেছেন। কিন্তু কিছুটা অন্তরালেই ছিলেন। অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন বোধহয়। মায়ের শেষযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন ভিডিও কনফারেন্সে। তার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নিজেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন।
ইরফানের কথা মনে পড়লেই কেন জানি না সবচেয়ে আগে মনে পড়ে ‘পান সিং তোমর’ ছবির কথা। বহু ভাল ভাল ছবি করেছেন। কিন্তু পান সিং আমার অলটাইম ফেভারিট হয়ে থাকবে। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই ছবির দৃশ্যগুলো সরে সরে যাচ্ছে মনে। সম্ভবত জীবনের ওই স্তর থেকে উঠে এসে অ্যাথলেটিক্সে সাফল্য পাওয়া এবং আশাভঙ্গ হওয়ার পর ‘বাগি’ হয়ে যাওয়া…। প্রোভার্বিয়াল আন্ডারডগের কাহিনিটা কোথাও একটা খুব টেনেছিল। তবে ইরফান অভিনয় না করলে পান সিংয়ের ‘পানত্ব’, ‘সিংয়ত্ব’ বা ‘তোমরত্ব’ কতটা থাকত জানি না। বিশেষত, ওই ডানহাতের তর্জনী ঘোরাতে ঘোরাতে একের পর এক দূরত্ব অতিক্রম করা। ওটা এক আশ্চর্য অভিজ্ঞান। একটা নিরুচ্চার নির্ঘোষ।আশ্চর্য নয় যে ওই অভিনয়ের জন্যই তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
ইরফানের জীবনও তো কম নাটকীয় নয়। মৃত্যুও। সব ঠিকঠাক চলতে চলতে আচমকা ক্যান্সার। বিদেশে চিকিৎসা। ফিরে আসা। আবার অসুস্থ হয়ে পড়া। তারপর চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে চলে যাওয়া। অনেকে বলছেন, লকডাউনে বিমান পরিষেবা বন্ধ থাকাটাই নাকি ইরফানের মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করল। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। যেতে পারেননি। কে জানে এ থিওরি সত্য না কল্পিত। তবে সবচেয়ে বড় এবং অমোঘ সত্য হল পৃথিবীতে আর ইরফান নেই।
দুপুর ১২.২৪
রাজ্যের এক সেলিব্রিটির ফোন। ধরতেই আর্তনাদ, ‘ইরফান নেই? এটা কি সত্যি?’
বললাম, সত্যি।
সেলিব্রিটি: উফ! ভাবতে পারছি না। গত পরশুই ‘পান সিং তোমর’ ছবিটা আবার দেখছিলাম। কী অসাধারণ অভিনয়! দৌড় নিয়ে তো ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ও হয়েছিল। কোথায় ইরফান আর কোথায় ফারহান!
ভাবছিলাম তাঁকে বলি, দুটো একেবারে দু’ধরনের ছবি। ইরফান আর ফারহান দু’জন দুই ছবিতে নিজের নিজের মতো করে দুর্দান্ত। দু’জনই চরিত্রে নিজেদের নিংড়ে দিয়েছেন। কিন্তু দু’জনের কোনও তুলনা চলে না। সুনীল গাভাসকার আর ভিভিয়ান রিচার্ডসের মধ্যে কি তুলনা হয়? কিন্তু বললাম না। কী হবে ওসব আলোচনা করে? বস্তুত, সেলিব্রিটি তখন গভীর চিন্তিত যে, ইরফানের মৃত্যুতে কী টুইট করবেন। প্রকারান্তরে পরামর্শও চাইলেন। বললেন, ‘আসলে বাংলায় আমি খুব ভাল পাঞ্চলাইন দিতে পারি। ইংরেজিটায় একটু সমস্যা হয়ে যায়।’
বললাম, লিখতে পারেন ‘দ্য ফোর্থ বাট দ্য বেস্ট খান গন টু সুন’। অথবা, ‘হি ওয়াজ দ্য রিয়েল ওয়ান, হুড কুড সে — মাই নেম ইজ খান’। ফোনে আবার সেলিব্রিটির আর্তনাদ ভেসে এল— ‘না–না! ওকে আমি ওই তিন খানের সঙ্গে তুলনা করতে পারব না বাবা!’ ভাবছিলাম, আবেগে কেঁদে না ফেলেন। আরও কিছু সাজেশন মাথায় এসেছিল। কিন্তু সেগুলো খুবই সাট্ল এবং বৌদ্ধিক। মনে হল, সেটা এই সেলিব্রিটির পোষাবে না। ওঁর একটু চড়া দাগ দরকার। একটু বেশি পাঞ্চ। তাই বললাম, ‘ভেবে নিন একটু তাহলে।’
ফোন কেটে গেল। বাঁচা গেল!
দুপুর ১.০০
বাবা–মা’কে খেতে দিতে গিয়ে দেখলাম বাবার টাক জুড়ে একটা ঘন সাদা আস্তরণ। তা নিয়েই দিব্যি ঘুরছে–ফিরছে। মা’কে বললাম, এরকম ভস্মমাখা সাধুবাবা হয়ে ঘুরছে কেন তোমার বর? মা সত্যিকারের বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আরে তেল মনে করে সারা মাথায় টুথপেস্ট মেখেছে! কতবার বারণ করলাম। কিছুতেই বুঝতে পারল না।’
শুনে কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর তোয়ালে ভিজিয়ে ভাল করে মাথাটা মোছালাম। বুঝলাম, জোর করে মাথা মুছিয়ে দেওয়াটা খুব একটা পছন্দ হয়নি। তবে বেশি প্রতিরোধও আসেনি। কী করেই বা প্রতিরোধ করবে! অত ডাকাবুকো চেহারা এখন দুর্বল, কঙ্কালসার। জোর নেই একরত্তি। শিশুর চেয়েও শিশু হয়ে গিয়েছে লোকটা। মায়া হয়।
দুপুর ৩.৫৫
ফেসবুক মেসেঞ্জারে অয়ন দাশগুপ্ত একটা ভয়েস ক্লিপ পাঠিয়েছেন। খুলেই চমকে উঠলাম! ইরফানের গলা। তার ঘন্টাখানেক আগে ভারসোভা সমাধিক্ষেত্রে স্ত্রী সুতপা শিকদার এবং তাঁদের দুই পুত্রসন্তান আয়ান ও বাবিলের সামনে কবরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫৩ বছরের অভিনেতার দেহ।
ইরফানের মৃত্যুতে খুব আন্তরিক টুইট করেছে সুজিত’দা। পরিচালক সুজিত সরকার। সারা পৃথিবী থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আছড়ে পড়ছে শোকের ঢেউ। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল, ইরফানের মতো শিল্পীর এই শেষযাত্রাটা প্রাপ্য ছিল না। হিন্দি তো বটেই, আন্তর্জাতিক ছবির জগতেও যিনি নিজের প্রতিভার চিহ্ন রেখেছেন, তাঁর এই অকাল বিদায় আরও মর্যাদাব্যঞ্জক এবং গরিমাময় হতে পারত। হওয়া উচিত ছিল। সাধারণ মানুষ আসতে পারল না। গোটা বলিউড ঘরে বন্দি। সমাধিক্ষেত্রে কেউ বিশেষ পৌঁছতেও পারেনি। শোনা যাচ্ছে শুধু বিশাল ভরদ্বাজ কোনওমতে পৌঁছেছিলেন। বাকিদের মধ্যে ইরফানের পরিজনরা। বাইরে কড়া পাহারা ছিল। যাতে কেউ সমাধিক্ষেত্রের ভিতরে ঢুকতে না পারে। এভাবে কেন যেতে হবে ইরফানকে? এটা অবিচার হল। ঘোর অবিচার।
সাউন্ড ক্লিপটা শুনে চমক লাগল! ‘আংরেজি মিডিয়াম’ ছবির প্রচারমূলক ভিডিও–রই হবে। ইরফান বলছেন, ‘নমস্কার। আমি এখন আপনাদের মধ্যে আছি। আবার নেইও। আমার শরীরে কিছু অতিথি বাসা বেঁধেছে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। দেখা যাক, তারা কোনদিকে যায়। বলা হয়, লাইফ গিভ্স ইউ লেমন। অ্যান্ড ইউ মেক আ লেমনেড। বলতে ভাল। কিন্তু জীবন যখন সত্যি সত্যিই হাতে একটা লেবু ধরিয়ে দেয়, তখন বোঝা যায় সেটা থেকে শিকঞ্জি (সরবত) বানানো কত কঠিন। কিন্তু আপনার পজেটিভ থাকা ছাড়া উপায় কী? এই পরিস্থিতিতে লেবু দিয়ে আপনি সরবত বানাতে পারলেন, নাকি পারলেন না সেটা তো আপনার উপর।’
ক্লিপিংটা বারবার শুনলাম। এত জীবন্ত! শেষদিকে ‘বি কাইন্ড টু ইচ আদার’ বলার পর যখন একেবারে শেষে ‘অ্যান্ড ইয়েস’ শব্দদুটোর পর কয়েক সেকেন্ডের ‘পজ’ দিয়ে গমগমে অথচ ঈষৎ ক্লান্ত গলায় ইরফান বলছেন, ‘ওয়েট ফর মি’, তখন সত্যি সত্যিই গায়ে কাঁটা দিল। বারবার!
বিকেল ৪.১৫
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, আগামী সোমবার, ৪ তারিখ থেকে রাজ্যের গ্রিন জোনে বেসরকারি বাস চলবে। তবে কি ৩ তারিখের পর সার্বিক লকডাউন উঠে যাবে? কে জানে! তবে বাস চললেও যাত্রীদের সকলকে মাস্ক পরতে হবে, বাস স্যানিটাইজ করাতে হবে এবং একটি বাসে ২০ জনের বেশি যাত্রী নেওয়া চলবে না। গ্রিন জোন যা দেখছি, উত্তরে আলিপুরদুয়ার থেকে দক্ষিণে ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত। তারপরেই অরেঞ্জ এবং রেড জোন। গ্রিন জোনে বাস চললেও মদের দোকান, সেলুন, চায়ের দোকান খুলবে না এবং ফুটপাথে হকার বসা এখন চলবে না।
মুখ্যমন্ত্রী আরও অনেককিছু বলেছেন অনেকক্ষণ ধরে। সেসব নিয়ে টিভি সারা সন্ধ্যা প্রচুর গবেষণা করবে। কাল সকালের কাগজেও বড় বড় করে বেরোবে। সেসব লিখে এই ডায়েরি ভারাক্রান্ত করতে চাইছি না। এটুকু উল্লেখ থাক যে, মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, তাঁর গতকাল খুব মাথায় ব্যথা হয়েছিল। মুখ্যসচিবেরও নাকি খুব পেটব্যথা।
রাত ১০.১৭
ইরফান খানকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। চেনার সুযোগ বা প্রশ্নও ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর ফেসবুকে যে উথলে ওঠা শোকপ্রস্তাব নেওয়া হল সারাদিন ধরে, তাতে ইচ্ছে করেই যোগ দিইনি।যেখানে অনেকেই দেখলাম ‘জজবা’ ছবির সেই বিখ্যাত ডায়লগটা রেফার করছেন, ‘আরে মোহাব্বত হ্যায় ইস লিয়ে তো যানে দিয়া, জিদ হোতি তো বাহোঁ মে হোতি।’
আমি জাস্ট তাঁর মাপা, চাপা এবং নীচুতারে বাঁধা অভিনয়ের কোটি কোটি ভক্তের মধ্যে একজন ছিলাম। তার বেশি কিছু নয়। চিরকাল সেই ভক্তই থাকব। ফলে দূরের কারও মৃত্যু যতটা সময় এবং মনোযোগ নেয়, ইরফান তার চেয়ে বেশি নেনওনি। তার বেশি তিনি দাবিও করেন না বোধহয়।
কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, তাঁর চলে যাওয়াটা কেন যেন ফাঁসের মতো গলায় চেপে বসছে! এই এত রাতে তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে কেমন দমবন্ধ লাগছে। সেটা কি তিনি বয়সে আমার চেয়ে মাত্রই দু’বছরের বড় ছিলেন বলে? যে সূত্রে আমি ভাবছি, জীবন সত্যিই এত অনিত্য হতে পারে? বা মৃত্যু এত অমোঘ? যে কোনও প্রার্থনা কোনও সেলিব্রিটিহুড বা কোনও জিনিয়াসের তোয়াক্কা করে না?
নাকি এইজন্য ভাবছি যে, আমি ভিতরে ভিতরে ইরফান খানের সাদামাটা ভক্তের চেয়েও বেশিকিছু ছিলাম? আসলে কি ওই আয়তচক্ষু, হাল্কা এলোমেলো দাড়ির মধ্যবিত্ত জিনিয়াসের মধ্যে কোনও অন্তর্লীন খ্যাপামি ছিল? আমি কি সেই চাপা, মাপা, কিঞ্চিৎ পাগলাটে অথচ মেধাদীপ্ত স্ক্রিন প্রেজেন্সেরই পূজারি ছিলাম বরাবর?
‘দ্য হাম্বলিং’ ছবিতে গুরুদেব আল পাচিনোর ডায়ালগ মনে পড়ছে, ‘দেয়ার ইজ আ থিন লাইন বিটউইন আ জিনিয়াস অ্যান্ড ইনস্যানিটি। অ্যান্ড হি হ্যাড ইরেজ্ড দ্যাট লাইন।’
প্রিয় অনিন্দ্য
ইরফান খুব প্রিয় অভিনেতা। চলে যাওয়াতে সারাদিন মনটা খারাপ থেকেছে যেমন থাকে
আরকি। রাতে আপনার ডাইরী পড়ে শেষে একটু যেন হাল্কা লাগছে।
ওই সেলেব্রিটির এন্ট্রিটা জাস্ট অতুলনীয়। ওনার চিন্তা ভাবনা ঠিক অনিন্দ্য সুলভ
রসিকতায় উপস্থাপন করা……হাসলাম খুব।
ভালো থাকবেন
নন্দিতা ভট্টাচার্য
LikeLike
আর আজ আরও দু’জন। মৃত্যু আর রসিকতা পাশাপাশি চলে…
আপনি ভাল থাকুন।
LikeLike