
২৩.০৪.২০২০। বৃহস্পতিবার
সকাল ৭.৩৪
এন্ট্রি শুরুর আগে তারিখটা লিখতে গিয়েই মনে হল, ঘটনাচক্রে আজ এই ডায়েরির একমাস পূর্ণ হল। গত ২৪ মার্চ লেখা শুরু করেছিলাম। আজ ২৩ এপ্রিল।
ডায়েরি লেখাটা আসলে একটা নেশার মতো। হতে পারে হাবিজাবিই লিখি। কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা নিষ্ঠা খোঁজার চেষ্টাও থাকে। মনে হয় কাম হোয়াট মে, ডায়েরিটা লিখতেই হবে। নিজের জন্যই। আত্মকথনের একটা মাদকতা আছে। অনেকটা আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতো। রোজ সেই শৃঙ্খলাটা রাখা গেলে একটা সেন্স অফ অ্যাচিভমেন্টও হয়।
ছেলেবেলায় আবাসিক স্কুলে পড়ার সময় নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম। তারপর আর কখনও লিখিনি। এই মধ্যবয়সে পৌঁছে আবার রোজ নিয়ম করে লেখা। মাঝখানের বছরগুলোতে লেখাটাই পেশা হয়ে গিয়েছে। বেতনভুক চাকর হিসেবে হাজার হাজার শব্দ লিখেছি গত ৩০ বছরে। লক্ষ লক্ষও হতে পারে। এতদিন পর পিছু ফিরে মনে হয়, লেখার কোটা বোধহয় পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তা–ও এই ডায়েরি লেখাটা ছাড়তে পারি না। লিখব। অন্তত যতদিন লকডাউন চলে। শৃঙ্খলাটা থাকুক।
সকাল ৭.৪৫
উপ্স, কী কাণ্ড! অর্ণব গোস্বামীর উপর হামলা। গতকাল রাত ১টা ২৪ মিনিটে একটা ৬ মিনিটের ভিডিও আপলোড করেছে অর্ণব। তাতে ও সটান বলেছে, রাত ১২টার কিছু পরে ও যখন স্ত্রী–কে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন দুই বাইক আরোহী ওর পথ আটকায়। তারা গাড়ির কাচ ভাঙার চেষ্টা করে। গাড়ির উপর তরল কিছু ঢেলে দেয়। অর্ণব কিছু স্পেসিফাই করেনি। কিন্তু মনে হল, বলতে চেয়েছে কালি ঢালার কথা। গাড়িতে তো আর অত রাতে কেউ বোতল থেকে মিনারেল ওয়াটার ঢালবে না! অর্ণব বাঁ’দিকে স্টিয়ারিং কাটিয়ে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পরে দেখে, ওর নিরাপত্তারক্ষীরা ২ জনকে আটক করেছে।
ভিডিও–তে অর্ণবের দাবি, ২ জনই যুব কংগ্রেসের কর্মী। তারা ওকে মারতে এসেছিল। ভিডিও ক্লিপিংয়ে নিজের বুকে চাপড় মারতে মারতে সনিয়া গান্ধীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে অর্ণব। বলেছে, আজ সকালেই যথাবিহিত পুলিশে অভিযোগ করবে। আরও বলেছে, সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। এর শেষ দেখে ছাড়বে।
আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার— রাত ৩টের সময় কংগ্রেসের নেত্রী অলকা লাম্বার টুইট, ‘যুব কংগ্রেস জিন্দাবাদ’।
গতকালই মনে হয়েছিল, #অ্যারেস্টঅ্যান্টিন্যাশনালঅর্ণব নামে ক্যাম্পেনের জল বহুদূর গড়াবে। অর্ণবের স্ত্রী সাম্যব্রতাকে চিনি দীর্ঘদিন। দুর্দান্ত রিপোর্টার ছিল। টেলিগ্রাফের হয়ে মুম্বইয়ে ভাল ভাল কপি করেছে বহুদিন ধরে। এখন ও–ও রিপাবলিকে কাজ করে। ওকে টেক্সট করে খোঁজ নিলাম। জবাবে ও অট্টহাস্যের স্মাইলি–সহ লিখল, ‘লড়াই–লড়াই–লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই।’
সকাল ৮.০৫
বাসন্তী’দিকে চাল, ডাল, আলু, তেল আর লবণ দিয়ে সাহায্য করেছেন কৃষ্ণা’দি। এখানে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা রইল। বাসন্তী’দি ভারী খুশি। বলল, ‘এখন কয়েকদিন আর চিন্তা নেই।’ আমারও একটু আশ্বস্ত লাগছে।
সকাল ৮.১৭
কেলেঙ্কারি করেছে! বিজেপি–র এমপি সৌমিত্র খাঁয়ের স্ত্রী কার্গো ফ্লাইটে চড়ে দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরেছেন এই বাজারে। ফিরেছেন তো ফিরেছেন। ওইপর্যন্ত থাকলে ঠিকই ছিল। কিন্তু খুশি খুশি মুখে ফেসবুকে গোটাচারেক ছবি পোস্ট করে বসেছেন। সেগুলোর সঙ্গে গাদাখানেক হার্টের ইমোজি দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘ঘরে ফেরার মজাই আলাদা। কলকাতা দ্য সিটি অফ জয়। অ্যান্ড দিল্লি দিলওয়ালোঁ কি’। ব্যস, আর যায় কোথায়! চারদিকে ঢি–ঢি পড়েছে। এ জিনিস কেউ করে!
কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল কলকাতা ও তার কাছাকাছি হটস্পটে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে। এটাও দেখতে হবে শেষপর্যন্ত কী হয়। সম্ভবত এরা ছ’দিনের সফরে এসেছে।
আজ তৃতীয়দিন।
কাল রাতে টিভি–তে দেখছিলাম, কেন্দ্রীয় সরকার কর্মচারীদের ডিএ একবছরের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে সম্ভবত রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্টে পাওয়ার কথা ছিল। এটা যথেষ্ট সাহসী সিদ্ধান্ত। দেশের সবচেয়ে নিরাপদ যে শ্রেণি, তাদের দিয়েই কৃচ্ছসাধন শুরু করা। এরপর বেসরকারি সংস্থাগুলোতেও ব্যাপক হারে বেতন ছাঁটাই শুরু হবে। সেটাই প্রত্যাশিত। এই করোনা যে আরও কতকিছু খেয়ে যাবে!
সকাল ৯.৪৫
আজই সেই হেস্তনেস্তর দিন। এবার বেরোতে হবে। হাইল্যান্ড পার্ক থেকে ‘শুভাদা’ নামের দেবদূতকে তুলে নিয়ে মৌলালি। একটু যে ভয় লাগছে না, তা নয়। তবে কিনা, ডর কে আগে জিত হ্যায়!
দুপুর ১.৫৫
হল না। এত আয়োজন সব বিফলে গেল। একটু আগে ডেন্টাল কলেজ থেকে অফিসে পৌঁছেছি। একটু জিরিয়ে নিয়ে গুছিয়ে লিখছি।
দুপুর ২.৩৪
শুভাদাকে তুলে ১১টার কিছু আগেই ডেন্টাল কলেজে পৌঁছে গিয়েছিলাম। রাজু ততক্ষণে চলে এসেছে। অন্য সার্জেনরাও হাজির। যুদ্ধক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। রাজুকে কাল রাতেই কপট হুমকি দিয়ে রেখেছিলাম, ব্যথা লাগলে কিন্তু ওখানেই গলা টিপে দেব! ওর নির্দেশেই বাঁ’কানের স্টাডটাও খুলে রেখে গিয়েছিলাম। চারদিকে খবর করে দিয়েছি। অফিসেও ছুটি নেওয়া আছে। খানিকক্ষণ হ্যাজানোর পর রাজু বলল এক্স–রে করে আসতে। করে এলাম। ততক্ষণে যে সার্জেন অপারেশন করবেন, তিনিও গাড়ি–টাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন।
এরমধ্যেই শুভাদা মোবাইল দেখে বললেন, নাট্যব্যক্তিত্ব ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় মারা গিয়েছেন। হার্ট অ্যাটাকই হবে সম্ভবত। শুনে মনে হল, লকডাউনের এই সময় যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তাঁরা শেষবেলার বিদায়মর্যাদাটুকুও পাচ্ছেন না। যেমন পাননি পি কে ব্যানার্জিও। তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াও হল কার্যত লোকচক্ষুর অন্তরালে।
এনিওয়ে, এক্স–রে প্লেটটা আসার পরেই রাজুর মুখচোখ বদলে গেল। তারপর ঘোষণা হল: ট্রিটমেন্ট পোস্টপোন্ড!
ভাবলাম, যাহ্, বলে কী? এত তামঝাম করে এত নোটিস দিয়ে এসে তারপর চিকিৎসাই পিছিয়ে দেওয়া হল? ততক্ষণে ঘরে একটা মিনি মেডিক্যাল বোর্ড বসে গিয়েছে। অন্তত চারজন প্লেটটা নিয়ে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে দেখছে এবং বিবিধ আলোচনা চলছে। যার কিছুই মগজে ঢুকছে না। ঢোকার কথাও নয়। ওরা অত লেখাপড়া করে ডিগ্রি পেয়েছে। আমি কোথাকার ফেকলু। শুভাদাও খানিক হতচকিত। শেষপর্যন্ত যা জানা গেল, তার মোদ্দা কথা— সাদা চোখে যা দেখা গিয়েছিল সেটা একরকম ছিল। এক্স–রে দেখে বোঝা যাচ্ছে কেস তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুচরণ। অতএব এখন কোনও প্রোসিডিওর করা যাবে না। ব্যথা না–থাকায় আপাতত দিনতিনেক ওষুধ চলবে। সঙ্গে নুনজলে গার্গল। আশা করা যায় এতেই কাজ হবে। অ্যাকিউট ব্যথা হবে না। হলে না হয় সেই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ডিজিটালি নামধাম লেখা এক্স–রে প্লেটটা ততদিন ওই ঘরের ব্র্যাকেট থেকেই ঝুলবে।
এরপর বেজায় আড্ডা হল। দেখা হল নরেন্দ্রপুরে আমার চেয়ে দু’ব্যাচ জুনিয়র তীর্থঙ্করের সঙ্গে। ও এখন ডেন্টাল কলেজেই পড়ায়। প্রচুর স্কুলের গল্প হল। প্লাস আমার পেশাগত অভিজ্ঞতার কাহিনি। ঠিক মনে হচ্ছিল কলেজ হস্টেল। হিমানীশ যখন মেডিক্যাল কলেজে পড়ত আর শীল ম্যানসনে থাকত, তখন এমন আড্ডা যে কত দিয়েছি! শেষে রাজুই আমাকে আর শুভাদাকে রাস্তার উল্টোদিকের বয়েজ হস্টেলের নীচে ক্যান্টিনে খেতে পাঠাল। বলতে কী, লকডাউনের আবহে রাজার ভোজ খেলাম। ভাত, পোস্ত ছড়ানো কুটি কুচি করে কাটা সাদা আলুভাজা, আলু–পটলের তরকারি, কাঁচা আমের ডাল আর সজনেডাঁটা–কাঁচকলা দিয়ে পাতলা একটা মাছের ঝোল। রাজুর গেস্ট বলেই নির্ঘাত ক্যান্টিনের ইন–চার্জ বাড়তি খাতির করছিলেন। ফলে তিনি যেচে এসে হাফ পেঁয়াজও দিয়ে গেলেন। জমে গেল!
পকেটের স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে খেয়েদেয়ে আবার হাত–ফাত ধোওয়া–মোছা করে ডেন্টাল কলেজে ফিরলাম এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বললাম। রাজু এবং তীর্থঙ্কর যা বলল, তাতে এখন আমার কোনওমতেই কোভিডে মরলে চলবে না। কারণ ওরা যে চিকিৎসা প্ল্যান করেছে, তাতে ঝাড়া একটি বছর লাগবে। সব নাকি ভুলভাল হয়ে আছে। শুনে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মনে মনে এবং প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা–সহ নিজেকে উহাদের হস্তে সমর্পণ করিলাম।
বেরোনর আগে রাজু একটা নতুন সবুজ মাস্ক দিয়ে বলল, ‘আমরা প্রথমদিকেই টেলার ডেকে বেডকভার কেটে কেটে প্রচুর মাস্ক বানিয়ে রেখেছিলাম। একেকটা বেডকভার থেকে ৪২টা মাস্ক হয়েছে। জানতাম পরে প্রচুর দরকার হবে।’
বেরোতে গিয়ে আরেক ফ্যাচাং! অনেক সকালে পৌঁছে যাওয়ায় অনেকটা ভিতরে গাড়ি রেখেছিলাম। বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। ফলে পিছনে গাড়ির ভিড় জমেছে। সকলকে অশেষ যন্ত্রণা এবং নিজেকে প্রভূত বিড়ম্বনা দিয়ে, লজ্জা লজ্জা মুখ করে গাড়ি ব্যাক করলাম। অন্তত পাঁচজন চিকিৎসক ট্র্যাফিক পুলিশের ভূমিকা নিলেন। তার খানিক আগে ডেন্টাল কলেজের পাশের দোকানে ১৬ টাকার ওষুধ নিয়ে ১৭ টাকা দিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম। ইচ্ছে করেই ব্যালান্স ফেরত নেওয়ার জন্য দাঁড়াইনি। ডাকলেন কাউন্টারের ভদ্রলোক— ‘একটাকা পাবেন আপনি।’ মন ভরে গেল।
শুভাদাকে পাশে বসিয়ে অফিসের দিকে রওনা হতে হতে ভাবলাম, আসলে পুরোটাই লাভে রইলাম। মুখের দাঁত মুখে রইল। সঙ্গে এতগুলো হিতৈষী বন্ধু পেলাম। কে বলে আমি দুর্ভাগা! অ্যাম দ্য বেস্ট অ্যান্ড দ্য লাকিয়েস্ট!
দুপুর ৩.৩৫
ঝাড়গ্রামের পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারের ছাদে উঠে বিনোদ কুমার নামে এক কনস্টেবল এ কে–৪৭ রাইফেল থেকে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করেছেন! কী কাণ্ড! টিভি–তে ফট ফট করে স্পষ্ট গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিনোদের কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। যদি রাইফেলের নল আকাশ থেকে নীচের দিকে নামিয়ে আনেন! মোবাইলে ফোন করে যোগাযোগ করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তিনি ফোন ধরছেন না। প্রথমে ২ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিলেন। তারপর নির্বিচারে। তবে এখনও কারও হতাহত হওয়ার খবর নেই। শূন্যেই গুলি চলছে। এসপি–র অফিস ঘিরে রেখেছে পুলিশ। এটা কি লকডাউন এফেক্ট? নাকি ছুটি না পাওয়ার পরিচিত ক্রোধ? কখন এবং কীভাবে বিনোদকে থামানো যাবে?
এডিট মিটের ডাক এসেছে। অশোক’দা মিটিংয়ে আমাকে দেখে নির্ঘাত অবাক হবেন।
বিকেল ৪.০৫
ঠিকই ভেবেছিলাম। অশোক’দা অবাক। আজ একটা ব্রাইট হলদে রংয়ের মাস্ক পরে এসেছিলেন। বিস্তারিত জানালাম কেন অপারেশন হল না ইত্যাদি। মিটিং থেকে ফিরে দেখছি, কেন্দ্রীয় দল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে গিয়েছিল। তারা শিলিগুড়িতে সিএমওএইচের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। অন্য দলটা রাজারহাটের কোয়ারেন্টিন সেন্টার পরিদর্শনে গিয়েছিল। সেখান থেকে এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে। পরিদর্শন সেরে তাঁরা নির্দিষ্ট অতিথি আবাসে ফিরে গিয়েছেন। তবে মুখ খোলেননি।
মুখ্যমন্ত্রী আজ সচেতনতা প্রচারে যাচ্ছেন মৌলালি আর বেহালা।
টিভি–তে দেখছি, ঝাড়গ্রামের বিনোদ কুমার ইতিমধ্যে ৪০ রাউন্ড গুলি চালিয়ে ফেলেছেন। তাঁর কাছে আরও ৬০ রাউন্ড গুলি আছে বলে টিভি বলছে। কতক্ষণে তাঁর গুলির ভাঁড়ার শেষ হবে কে জানে! তারপর কী হবে, তা–ই বা কে জানে!
বিকেল ৪.৩৩
মুখ্যসচিব জানালেন, গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে ৫৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ২৪ জন সুস্থ হয়েছেন। রাজ্যে মোট করোনা অ্যাক্টিভ রোগী এখন ৩৩৪ জন। মৃতের সংখ্যা এখনও ১৫। সংখ্যা বাড়েনি। মুখ্যসচিব আরও জানাচ্ছেন, রাজ্যে এখন মোট ১২টি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা পর্যাপ্ত পরিমাণেই হচ্ছে।
দেশে গত ২৮ দিনে ৭৮টি জেলা থেকে কোনও কেস আসেনি।
বিকেল ৫.৩৪
একটা অপার্থিব দৃশ্য দেখে এলাম বারান্দায়। এইমাত্র। জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে একটু আগে। গাছপালাগুলো সব স্নান সেরে উঠেছে সদ্য। তখন আকাশ কালো করে এসেছিল। এখন মেঘ কেটে গিয়েছে। নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ ভেলা ভাসিয়েছে। আর অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়েছে কাছে–দূরের গাছপালা এবং ইমারতগুলোর মাথায়। মনে হচ্ছে, ঝলমলে সোনা দিয়ে মোড়া মুকুট পরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকলে। চারদিকে একটা আশ্চর্য সোনালি আলোর বিচ্ছুরণ। খুনখারাপি আগুন রংয়ের আকাশ। তার মধ্যে ঝলমল করছে একটা আস্ত রামধনু! সেই রামধনু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশচেরা বিদ্যুতের রুপোলি রেখা। স্বপ্নের মতো।
এমনিতে নিজেকে রসকষহীন মানুষ বলেই জানি এবং জাহিরও করি। আজ চারপাশের টেরিফিক দৃশ্য দেখে আপনা থেকেই বেরিয়ে এল, ‘বাহ্!’ ভাগ্যিস ধারেপাশে কেউ ছিল না।
সন্ধ্যা ৬.০৪
কমলিকা ২৪ ঘন্টায় একটা ভাল স্টোরি করেছে। এবার করোনা মোকাবিলাতেও রাজ্য সরকারকে সহায়তা করতে ময়দানে নেমেছেন প্রশান্ত কিশোর। ঘটনাচক্রে, প্রশান্ত ১০ বছর রাষ্ট্রসঙ্ঘে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে এসেছেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাই নাকি কাজে লাগাতে চাইছে রাজ্য সরকার। প্রশান্ত কাল বিশেষ বিমানে কলকাতায় এসেছেন। অভিষেকের সঙ্গে একদফা মিটিং করেছেন। তারপর রাজ্য সরকারের বিভিন্ন স্তরে কথাবার্তা বলে পরিস্থিতির খতিয়ান নিচ্ছেন। ইন্টারেস্টিং!
সন্ধ্যা ৬.২৪
তারিক বাড়ি থেকে ওর স্ত্রী–র তৈরি করা পাটিসাপ্টা এনেছে। আমাকে একটা খাওয়াল। ব্যাপক খেতে। যা দেখা যাচ্ছে, আজকের দিনটা মূলত খাওয়ার উপরেই আছি। দুপুরে ফোর কোর্সের খ্যাঁটন আর এখন সন্ধ্যায় পাটিসাপ্টা। এসব কী যে হচ্ছে!
চোখে দেখতে না পেলেও একটা প্লেনের আওয়াজ পেলাম মেঘের আড়াল থেকে। এটা কি সেই বহু আলোচিত কার্গো ফ্লাইট? যার একটায় রাজ্যে এসেছে কেন্দ্রীয় দল? আর এসেছেন বিজেপি–র এমপি সৌমিত্র খাঁয়ের স্ত্রী।
পরে অবশ্য দেখলাম তিনি দিল্লিতেই আছেন। এবং সেখানে দাঁড়িয়েই তিনি দাবি করছেন, ওটা নিছক মজা করে পোস্ট করা একটা পুরনো ছবি।
সন্ধ্যা ৬.৩০
রামধনু–টামধনু আপাতত ভুলিয়ে দিয়ে বাজ পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের আকাশে! রাজ্যপালকে কড়া চিঠি লিখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যেখানে তিনি সাফ সাফ লিখেছেন, ‘আপনি মনে হয় ভুলে গিয়েছেন, আমি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আর আপনি একজন মনোনীত রাজ্যপাল। আপনার কথা বলার ভঙ্গি ও শব্দচয়ন অসাংবিধানিক। আপনি আমার মন্ত্রী ও অফিসারদের আক্রমণ করছেন। আপনার মন্তব্য আমার অফিসকে অপমান করেছে!’
গত কয়েকদিন ধরেই খিটিরমিটির চলছিল রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের। গতকালও মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে লক্ষ্য করে কড়া কটাক্ষ করেছিলেন। আজ পাঁচ পাতার চিঠিটা প্রকাশ্যে এনে বোমাবর্ষণ করেছেন। বলেছেন, বাধ্য হয়েই এই চিঠি তাঁকে জনসমক্ষে আনতে হয়েছে। এই মমতা কিন্তু ক্রুদ্ধ এবং ক্ষিপ্ত। এই মমতা হলেন সেই নেত্রী, সহ্য করতে করতে যাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে এবং যিনি প্রত্যাঘাত করেছেন।
ঘটনা হল, মমতার চিঠির জবাবে রাজ্যপাল দ্রুত টুইট করেছেন এই বলে যে, মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি তথ্যগতভাবে ভুল এবং সাংবিধানিকভাবে দুর্বল। এবার কিন্তু সত্যি সত্যিই লেগে গেল! যদি না রাজ্যপাল অবিলম্বে তাঁর কিচিরমিচির বন্ধ করেন। তবে টুইট দেখে মনে হচ্ছে না, তিনি সে পথে হাঁটার বান্দা। কারণ তিনি বলেছেন, তাঁর প্রাথমিক জবাব মিডিয়াকে জানাবেন রাত পৌনে ৮টা নাগাদ। এবং চূড়ান্ত জবাব কাল বেলা ১১টায়।
সন্ধ্যা ৭.১৩
দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে ‘হু’–এর হুলোর অতিমারীর সময় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ইনস্টাগ্রাম লাইভে কথোপকথন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল। যা আজ সন্ধ্যায় হওয়ার কথা ছিল। দীপিকা নিজেই তাঁর লেটারহেডে বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছেন। কী কারণে, তা জানার মতো এলেম আমার মতো লেসার মর্টালের নেই।
রাত ৯.০৫
ঝাড়গ্রামের পুলিশ কনস্টেবল বিনোদ কুমার এখনও পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারের ছাদে। দরজায় তালাবন্ধ করে তাঁকে ছাদেই আপাতত আটক রাখা হয়েছে। গুলি ফুরিয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু অনেকক্ষণ গুলির আওয়াজ শোনা যায়নি। বোধহয় রাতের অন্ধকারে তাঁকে নামিয়ে আনার একটা চেষ্টা করা হবে।
রাজ্যপাল টুইট করেছেন যে, তাঁর প্রাথমিক জবাব পাঠিয়ে দিয়েছেন। কাল সকাল ১১টায় একেবারে চূড়ান্ত জবাব দেবেন। কীভাবে করোনা গাইডলাইন মেনে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন, আপাতত তার মোডালিটিজ নিয়ে গভীর আলোচনা চলছে। জানা যাচ্ছে, রাজ্যপালের চিঠিও পাঁচপাতারই। সেখানে তিনি নাকি লিখেছেন, ক্রোধ থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ওই চিঠি লিখেছেন।
রাত ৯.২৫
বিনোদ কুমারকে নামিয়ে আনা হয়েছে। পুরুলিয়া থেকে তাঁর বাবা–মা’কে এনে তাঁর সঙ্গে কথা বলিয়েছিল পুলিশ। সম্ভবত তাতেই কাজ হয়েছে। রাইফেলটি ছাদে রেখে তিনি নেমে এসেছেন। আপাতত তাঁকে এসপি–র অফিসে জেরা করা হচ্ছে।
রাত ৯.৪০
যা ভেবেছিলাম, অর্ণবের উপর হামলা নিয়ে জল গড়াচ্ছে। কংগ্রেস হাইকম্যান্ড রিঅ্যাক্ট করেনি। দুই হামলাকারীর নাম অরুণ বোরদে এবং প্রতীক মিশ্র। অর্ণবের দাবি, এফআইআর লঘু করে দেওয়া হয়েছে। এবং সেই এফআইআরও ফাইল করতে দেওয়া হয়েছে ১০ ঘন্টা পর। যা দেখলাম, গাড়িতে বোধহয় কালিই ঢালা হয়েছিল। কারণ, সাদা গাড়ির গায়ে কালির পোঁচ দেখা যাচ্ছে।
রাত ১০.৪৪
অফিস থেকে ফেরার সময় মাথা তুলে দেখলাম উপরে পরিষ্কার, স্পষ্ট, ঝকঝকে আকাশ। কোনও ধোঁয়া নেই। ধুলো নেই। মালিন্য নেই। নিকষ কালো পটভূমিকায় তারার হাট বসেছে। এও এক অদ্ভুত সমাপতন যে ঠিক সেই সময় কাছাকাছি কোনও বাড়ি থেকে মহিলা কণ্ঠে খালি গলায় গান ভেসে আসছে, ‘আজি যত তারা তব আকাশে’।
এই ইমেজারিটা মনে রেখেই আজ ডায়েরি বন্ধ করি বরং।