
২১.০৪.২০২০। মঙ্গলবার
সকাল ৮.২০
আজ সকালটা খুব, খুবই অন্যরকম। ঠাণ্ডা–ঠাণ্ডা। কুল–কুল। টিপিক্যাল ইংলিশ ওয়েদার। তার মধ্যে দূরে কোনও একটা বাড়ি থেকে ভেসে আসছে, ‘বহে জীবন রজনী–দিন চির নূতন ধারা..’।
অন্যরকম লাগছে কাল রাত থেকেই।
কাল রাতে বাড়ি ফিরে ব্লাস্ট ফার্নেসের সমস্ত জানালা–দরজা খুলে দিয়েছিলাম। তখন প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাজ পড়ছে বিকট শব্দে। প্রচণ্ড হাওয়ায় বেডরুমের জানালার পর্দাগুলো ফুলেফেঁপে উঠছে। বেডসাইড ল্যাম্পের হলদে আলোয় ঘরটাকে প্রায় স্বর্গের মতো লাগছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ভাগ্যিস আমার ফ্যাটফ্যাটে টিউবলাইট ভাল লাগে না। ভাগ্যিস আমার সব বাড়ির সব ঘরে এমন হলদে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে। ভাগ্যিস!
স্বর্গ কি আর আকাশ থেকে পড়ে? স্বর্গ তৈরি করতে হয়। যত্ন দিয়ে। রুচি দিয়ে। মমতা দিয়ে।
সকাল ৮.৫৭
আমেরিকায় নাকি অপরিশোধিত তেলের দাম শূন্যে গিয়ে ঠেকেছিল কাল! অলটাইম লো। এতটা বাড়াবাড়ি রকমের নেমেছিল নাকি সেই ১৯৯৯ সালে। এখন একেবারে শূন্য! অবশ্য সেটা অস্বাভাবিকও নয়। গোটা পৃথিবীতে গাড়িঘোড়া, প্লেন কিচ্ছু চলছে না। ফলে তেলের চাহিদা নেই। আবার তেল মজুতও রাখা যাচ্ছে না। জায়গার অভাব। চাহিদা কমলে দাম তো কমবেই। আজ অবশ্য আবার খানিক দাম উঠেছে। সাধে কি রসিক টুইট–কার রমেশ শ্রীবৎস লিখেছেন, ‘হোয়াট? অয়েল প্রাইসেস আর নেগেটিভ নাউ? সো আই ক্যান গেট পেইড ফর বায়িং অয়েল? হোয়াট হ্যাপেন্ড? ফ্লিপকার্ট টুক ওভার অর হোয়াট?’
সকাল ৯.৫৯
করোনা–পরিস্থিতির সাপেক্ষে সাময়িকভাবে অভিবাসন দেওয়ার নীতি বাতিল করে দিল আমেরিকা। প্রসঙ্গত, এখনও পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু ৪২ হাজার। এর মধ্যে আবার কর্মস্থলে সুরক্ষার দাবি তুলে ধর্মঘট শুরু করেছেন অ্যামাজনের কর্মীরা। ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন মূলত ওয়্যারহাউস কর্মীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ১৩০টির মতো ওয়্যারহাউস রয়েছে আমাজনের। কর্মীদের দাবি, তাঁদের প্রায় ৩০ জন কোভিড–১৯ পজেটিভ হয়েছেন। কর্মস্থলের পরিবেশ অত্যন্ত নিম্নমানের। লকডাউন শুরুর পর অ্যামাজনের অর্ডারের সংখ্যা প্রভূত বেড়েছে। সিয়াটেলের এই ই–কমার্স সাইটের শেয়ারদরও তাই তুঙ্গে। ধর্মঘট হলে কী হবে কে জানে!
সকাল ১০.৩১
আমেরিকার একটা কাগজের ওয়াশিংটনের করেসপন্ডেন্ট একটা কপি করেছেন। হেডিং: রিলিফ ফর ভাইরাস অ্যাজ ইট টেস্টস্ নেগেটিভ ফর ট্রাম্প’।
সেই কপি বলছে, গতকাল রাত থেকে মারণ ভাইরাস কোভিড–১৯ খুব আশ্বস্ত বোধ করছে। কারণ, জানা গিয়েছে সে ট্রাম্প–নেগেটিভ। গত কয়েকদিন ধরে ওই ভাইরাসের মধ্যে অশিক্ষা, মূর্খামি এবং ব্যাপক ইগোটিজমের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। যা থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সে ‘পোটাস–৭৩’ দ্বারা সংক্রমিত। যা এমনিতে ‘মরোনাভাইরাস’ বলে পরিচিত। যাই হোক, এখন অল ক্লিয়ার সঙ্কেত পাওয়ার পর সে আবার নতুন করে মানবসভ্যতা ধ্বংসের কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে।
‘পোটাস’ হল মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিকনেম। ‘প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’এর শব্দগুলোর ইংরিজি আদ্যক্ষরের সমাহার। আর ট্রাম্পের বয়স এখন ৭৩। বোঝা গেল?
পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এ তো সংবাদপত্রের স্বাধীনতার হদ্দমুদ্দ। সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকের স্বাধীনতা কোন পর্যায়ে গেলে এই কড়া সেন্স অফ হিউমারের অনুপান দিয়ে এই ভাষায় এই ধরনের স্টোরি ছাপার অক্ষরে ক্যারি করা যায়! ভারতে এটা করা হলে? নির্ঘাত সাতদিনের জেল আর তিনমাসের ফাঁসি।
বেলা ১১.১১
বাইরে একটা মাতাল হাওয়া বইছে। লকডাউনে সো ফার বেস্ট ওয়েদার। সল্টলেকে এমনিতেই গাছপালার আধিক্য। তারপর এই পাগলা হাওয়া। এমন দিনে অফিসে যেতে মন নাহি চায়। মেঘলা আকাশ। প্রবল হাওয়ায় বেডকভার পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে। ল্যাদ খাওয়ার জন্য আদর্শতম দিন। বলছে, এমনই নাকি থাকবে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত। মনে হচ্ছে প্রকৃতি গোটা চরাচরকে যত্ন করে স্নান করিয়ে, গা মুছিয়ে দিয়েছে। তাই চারদিক এত পয় পরিষ্কার। শান্ত। স্নিগ্ধ। স্বর্গীয়।
মাঝে মাঝে ভাবি, আজকাল কত অল্পে খুশি হয়ে যাই। এই যে সুইচ টিপলে আলো জ্বলছে, পাখা চলছে, ইন্টারনেট কাজ করছে— এটাই বা কম কীসের? আর তার সঙ্গে যদি এমন পাগলপারা ওয়েদার থাকে? টোটাল ব্লিস।
বেলা ১১.২০
কপিলদেব মাথা ন্যাড়া করে ফেলেছে। ওরে নাহ্! এটা কিন্তু ফাটিয়ে দিয়েছে। ন্যাড়া মাথা। একগাল দাড়ি। এটা যে কতবার করব ভেবেছি! এখনও সাহস হয়নি। যদি এমনিতেই উজবুক চেহারাটা আরও বোকা বোকা লাগে? কিন্তু কোনও না কোনওদিন যা থাকে কপালে বলে ঠিক করেই ফেলব। করবই। আরও কিছু কিছু জিনিসের মতো ওটাও আমার বাকেট লিস্টে আছে। ইনশাআল্লাহ্!
আপাতত দেবাশিস’দাকে বলি কপিলকে ধরে এটা নিয়ে একটা কপি করতে।
বেলা ১১.৪৯
একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য পেলাম। ভবিষ্যতের সূচক হিসেবে ডায়েরিতে লিখে রাখি। আগামী ডিসেম্বর মাসের জন্য গোয়ায় ফাইভ স্টারের বুকিং দেখাচ্ছে ১,৯০০ টাকা পার ডে। বোঝা যাচ্ছে, যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ঝাড় হবে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিতে। সেটাই স্বাভাবিক। লোকের ক্রয়ক্ষমতা বলে কি আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে? থাকবেও না বহুদিন। পাঁচতারা হোটেলের রেট দিনপ্রতি ২,০০০ টাকারও কম! তাও ডিসেম্বরের হুল্লোড়ভর্তি গোয়ায়! ছোট হোটেল–রেস্টুরেন্টগুলো তো জাস্ট বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
দুপুর ১২.৩১
পাশের বাড়ির আমগাছ থেকে গোটাপাঁচেক আম চুরি করেছি। পাপস্খালনের জন্য এই ডায়েরিতে স্বীকারোক্তি করে নিলাম। দুটো বাসন্তী’দিকে দিলাম। বাকিগুলো কি অফিসে নিয়ে যাব? নাহ্, থাক। কিন্তু নেব না–ই বা কেন? আমি তো না বলিয়া পরের দ্রব্য লইতেছি না। ডায়েরিকে বলিয়াই লইতেছি।
দুপুর ১২.৪৫
ওরেব্বাস! একটু আগে ছাদে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, কাল রাতে ঝড়ে প্রচুর আম পড়েছে। অন্তত ১০ কিলো হবে ওজন করলে। পাশের বাড়ির গাছটা থেকেই পড়েছে। কিন্তু ছাদ তো আমাদের! ছাদ যার, ছাদে প্রকৃতির এনে–দেওয়া বস্তুও তার। দ্য রুল ইজ সিম্পল। সবগুলো আম একটা বস্তায় ভরে অফিসে নিয়ে যাব বলে ঠিক করলাম। কাঁচামিঠে আম। ভিটামিন ‘সি’ আছে। কোভিডে নাকি ভিটামিন ‘সি’ অবশ্যভোগ্য।
দুপুর ১.১৭
ঘর পরিষ্কার করতে করতে বাসন্তী’দি বলছিল, দু’দিন পুলিশ ওদের চাল দিয়েছিল। এখন আর দিচ্ছে না। ঘরে চাল বাড়ন্ত। শুনে বললাম, আমার কাছে চাল আছে। নিয়ে যাও। জবাব এল, ‘না–না। তোমাদের ভাল চাল। ওই চাল নিতে পারব না। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে। আমরা তো মোটা চাল খাই। সেটাই যদি পুলিশ–টুলিশকে বলে একটু যোগাড় করা যেত।’
নিজের ঘোর দুর্দিনেও করিনি। কিন্তু আজ সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা’দির নম্বর ডায়াল করলাম। সরাসরিই বললাম, এই মানুষগুলো তো না খেতে পেয়ে মারা যাবে এরপর। আরও কঠোর হবে লকডাউন। কারা পৌঁছবে এদের কাছে? দিন–আনা দিন–খাওয়া মানুষগুলো সব। যদি একটু সাহায্য করেন। বিধাননগরের মেয়র বললেন, ‘এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আপনার নাম বললেই দিয়ে দেবে চাল। আর কোথায় কোথায় এমন সাহায্য দরকার মানুষের, খোঁজ পেলে অবশ্যই জানাবেন।’
বাসন্তী’দিকে বললাম, এক্ষুনি যাও!
একগাল হেসে যখন দৌড়পায়ে একতলায় নামছেন মহিলা, তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আগে শোনা কথাগুলো ভাবছিলাম। ‘তোমাদের ভাল চাল। ওই চাল নিতে পারব না। অভ্যেস খারাপ হয়ে যাবে। আমরা তো মোটা চাল খাই।’ কে বলল, গরিব মানুষের মর্যাদাবোধ থাকে না? কে বলে, তাঁদের কাছে কিছু শেখা যায় না? কম পড়ালেখা জানা বাসন্তী’দি বিরাট জীবনশিক্ষা দিয়ে গেল।
দুপুর ৩.০০
অফিসে পৌঁছে লিখছি। আসার পথে একজোড়া পাতলা সার্জিক্যাল গ্লাভস কিনলাম। বিশাল কোনও সুস্বাস্থ্যজনিত কারণ নেই। স্রেফ পরার ইচ্ছে হয়েছে। কাঁচা আমের বস্তাটাও নিয়ে এসেছি। বিপ্লবের জিম্মা করে দেব। ও ডিস্ট্রিবিউট করে দেবে। তারপর আজ রাতে আবার ঝড় হলে কাল ফের আম–আশা।
বিকেল ৪.০৫
মুখ্যসচিবের সঙ্গে কেন্দ্রীয় দলের বৈঠক হয়েছে। তাঁরা বলছেন, রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন। তবে কোনও সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তাঁদের নাকি হটস্পটে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এবং বিশাল কনভয় নিয়ে কেন্দ্রীয় দল আপাতত শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিজেপি–র এই ব্যাড পলিটিক্সের মোকাবিলা গুড পলিটিক্স দিয়ে করা যেত। বলা যেত, আগে থেকে না জানিয়ে আপনাদের হুট করে চলে আসাটা খারাপ হয়েছে ঠিকই। তবে এসেই যখন পড়েছেন, ফেরাব না। যা দেখার ঘুরেটুরে দেখে নিন। ঘটনাচক্রে, যে সমস্ত জেলার তালিকা নিয়ে কেন্দ্রীয় দল এসেছে, তার মধ্যে অধিকাংশ জায়গাতেই গত ১৫ দিনে কোনও নতুন কেস নেই। গিয়েও কিছু পেত না। ফলে ভাল সার্টিফিকেট দিয়েই যেতে হতো। কিন্তু আমি এসব বলার কোন উলুখাগড়া!
আহ্, মুখ্যসচিব এইমাত্র জানালেন, নীতিগতভাবে বিষয়টা তাঁদের অপছন্দ হলেও তিনি কেন্দ্রীয় দলের সদস্যদের বলেছেন তাঁরা যেখানে খুশি যেতে পারেন। কলকাতা পুলিশ তাঁদের এসকর্ট করে নিয়ে যাবে। দিস ইজ গুড পলিটিক্স।
মুখ্যসচিব জানাচ্ছেন, রাজ্যে করোনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৫। আরও বললেন, এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৬,১৮২ জনের করোনা টেস্ট হয়েছে। তার মধ্যে কাল থেকে আজকের মধ্যে হয়েছে ৭১৩ জনের টেস্ট। মুখ্যসচিবের কথায়, ‘কোয়ান্টাম জাম্প।’
বিকেল ৪.৩০
কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতা প্রচারে নেমেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। পার্কসার্কাস, রাজাবাজার, তপসিয়া, ধাপার মাঠপুকুর, ভবানীপুর, রাসবিহারী–সহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গাড়ির সামনের সিটে বসে কর্ডলেস মাইক্রোফোন নিয়ে হিন্দি এবং বাংলায় বলছেন লকডাউন মানার কথা। বলছেন, কোনও সমস্যা হলে পুলিশকে জানান। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পরে সাফাইকর্মীদের হাতে ঝাড়ু তুলে দিচ্ছেন। একদিকে কেন্দ্রীয় দল রাস্তায় ঘুরছে। অন্যদিকে ঘুরছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কেস জমে গিয়েছে। আপাতত দু’পক্ষই সেন্টার সার্কলের কাছাকাছি বল হোল্ড করে খেলছে। দেখা যাক।
মেডিক্যাল কলেজে একের পর এক চিকিৎসক, নার্স আর জুনিয়র ডাক্তারদের পজেটিভ রিপোর্ট আসছে। এটা চিন্তার। গভীর চিন্তার। এরপর না মেডিক্যাল কলেজটাও বন্ধ করে দিতে হয়!
বিকেল ৫.৩৯
বলতে বলতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের কড়া চিঠি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে। প্রকারান্তরে হুঁশিয়ারিই বলা যেতে পারে। বিষয় খুব সরল— রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় দলকে জলপাইগুড়ি এবং কলকাতায় কোনও সহযোগিতা করছে না। তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা করা চলবে না। কারণ, কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী এই দলকে চারটি রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। অন্য সব রাজ্য সহযোগিতা করলেও পশ্চিমবঙ্গ করছে না। সেন্টার সার্কল থেকে কিন্তু এবার উইং দিয়ে ঢুকছে একপক্ষ। উত্তেজনা, উত্তেজনা।
বিকেল ৫.৪৭
সার্জিক্যাল গ্লাভস বেশিক্ষণ পরা গেল না। এসব হল শিল্পীদের জিনিস। যাঁরা স্ক্যালপেল ধরেন। আমার হল বিড়িশ্রমিকের হাত। চাকরের তালু। প্রথমত, ভিতরে পাউডার জাতীয় কী একটা থাকায় আঙুল স্লিপ করছে কি–বোর্ডে টাইপ করতে গিয়ে। দ্বিতীয়ত, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিতরে হাতের তালু–টালু ভেপে যাচ্ছে। খুলেই ফেললাম শেষপর্যন্ত। খালি হাতেই ঠিক আছে। দরকার হলে আরেকটু বেশি স্যানিটাইজার দিয়ে নেব। তবে অভিজ্ঞতাটা হয়ে রইল। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি ভক্তি আরও বাড়ল। গ্লাভসের নমুনাই যদি এই হয়, তাহলে পিপিই কী হবে! প্রণাম।
সন্ধ্যা ৭.১০
এইমাত্র টুইটারে একটা ভিডিও দেখলাম। ওই ৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের পর সবকিছু অসাড়, অসার, নিরর্থক এবং অন্তঃসারশূন্য মনে হচ্ছে। কলম সরছে না। পরে লিখছি। একটু সামলে নিই।
রাত ১০.৪৫
আজকের শেষ এন্ট্রিটা করছি। এখনও কলম সরছে না। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বোবা লাগছে। কিন্তু রেকর্ডের জন্য লেখা থাক যে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ২০২০ সালের এপ্রিলে এমন একটি ঘটনাও ঘটেছিল।
চেন্নাইয়ের চিকিৎসক প্রদীপ কুমার ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, ‘নিজে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে নিয়ে গিয়েছি। কবর খুঁড়েছি নিজের হাতে। মাটি দিয়েছি নিজের হাত দিয়ে তুলে। হাতের কাছে মাটি দেওয়ার মতো আর কিছু ছিল না। ডাক্তার হিসেবে আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি। কিন্তু এত ভয় কখনও পাইনি! এমন ঘটনা যেন আমার শত্রুর সঙ্গেও না হয়।’
গত রবিবার চেন্নাইয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় প্রদীপের সহকর্মী চিকিৎসক সাইমনের। যিনি করোনা–আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে করতে নিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওইদিন রাতে যাবতীয় সুরক্ষাবিধি মেনে দেহ নিয়ে যাওয়ার সময় প্রদীপরা জানতে পারেন, পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে কিছু লোক বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। দ্রুত বিকল্প জায়গা ঠিক হয়। সেখানে যখন তাঁরা অ্যাম্বুল্যান্সে সাইমনের দেহ নিয়ে পৌঁছন, তখন এলাকা ফাঁকা। দেহ কবরে নামানোর পর বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে। তারপর উন্মত্ত জনতা শুরু করে পাথরবৃষ্টি। অতঃপর ধেয়ে এসে সরাসরি বেধড়ক মার। দাবি একটাই— করোনায় মৃতের দেহ সমাধিস্থ করা যাবে না। সে তিনি যতই করোনা–আক্রান্তদের চিকিৎসায় জীবন দিয়ে থাকুন!
পাথরের ঘায়ে অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভারের মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। মাথা ফাটে আরও কয়েকজনের। অ্যাম্বুল্যান্সের সমস্ত কাচ ইটের ঘায়ে চুরমার হয়ে যায়। সেই অবস্থাতেও চালক দৌড়ে গিয়ে কোনওমতে সাইমনের দেহ তুলে আনেন কবর থেকে। অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে ফিরে যান হাসপাতালে। অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে পিছনে প্রদীপ ফেরেন তাঁর নিজের গাড়ি চালিয়ে। গাড়ি চালাতে চালাতেই তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এবং পুলিশের হস্তক্ষেপ চান।
ততক্ষণে সাইমনের দেহ–সহ ভাঙা অ্যাম্বুল্যান্স হাসপাতালে ফেলে রেখে পালিয়েছেন চালক এবং অন্যরা। ধারেপাশে কেউ নেই। অগত্যা প্রদীপ নিজেই পিপিই পরেন। দুই ওয়ার্ডবয়কে রাজি করান পিপিই পরতে। তারপর তাঁদের দু’জনের সাহায্যে ভাঙা অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে আবার পৌঁছন সেই সমাধিক্ষেত্রে। ততক্ষণে পুলিশ এলাকা ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু বাইরে তুমুল বিক্ষোভও চলছে।
৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের ভিডিও–র শেষদিকে গলা থেকে দমকে দমকে কান্না উঠে আসছিল প্রদীপের। ভেঙে পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি জোড়হাতে বলে যাচ্ছিলেন, ‘এ যেন কখনও আমার শত্রুর সঙ্গেও না হয়!’ বলছিলেন, ‘আমি একবার নিজের জীবনের জন্য ভয় পাচ্ছিলাম। আবার ভাবছিলাম, আমি ভয় পেয়ে চলে গেলে ওরা যদি এসে আবার সাইমনের দেহটা কবর থেকে তুলে ছুড়ে কোথাও ফেলে দেয়! তাই নিজের হাতে কবর খুঁড়েছি। নিজের হাতে কাদামাটি টেনে টেনে এনে আমার বন্ধুর দেহের উপর চাপিয়েছি। কী করব বলুন? মাটি দেওয়ার জন্য হাতের কাছে কোনও বেলচা বা কোদাল ছিল না। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছিল, সাইমনের স্ত্রী–পুত্র তখনও সামনে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখের সামনে তাদের প্রিয় মানুষটা মৃত্যুর পরেও ওইভাবে অপমানিত হবে?’
চুলোয় যাক মাতাল হাওয়া। দরকার নেই হলদে আলোয় ভাসাভাসি বেডরুমের স্বর্গ। এখন আকাশভাঙা বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এক তরুণ চিকিৎসকের চোখের জল।
অ–শুভরাত্রি!
প্রদীপ দের জন্য এই মূহুর্তে কোন বিশেষণ ই যথেষ্ট নয়!! চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের এই লড়াই নতুন ভোর আনবে…
LikeLike
আনলেই ভাল
LikeLike
অশুভ মানসিকতা…এই মনুষ্যেতর প্রজাতির ক্ষমা নেই..
LikeLike