
১৭.০৪.২০২০। শুক্রবার।
রাত ২.০৩
ভয়ঙ্কর আওয়াজ করে একটা বাজ পড়ল। তাতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু এত ক্লান্ত লাগছিল যে আর বাইরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল না। একটু একটু মেঘও ডাকছে দূরে দূরে।
সকাল ৮.০৭
আজ অ্যালার্ম শুনে ঘুম ভাঙেনি। তারপর ভাঙল নিচে কাপড় কাচার ধপাধপ আওয়াজে। বুঝলাম, বাসন্তী’দি এসেছে। কী করে এল কে জানে! তবু এসেছে যখন ভালই হয়েছে। নীচের ঘরগুলো একটু মুছে দিয়ে যেতে পারবে। আপাতত চা বানাই।
সকাল ৮.২০
ফেসবুকে বাংলাদেশের চিকিৎসক বন্ধু সুব্রত ঘোষ একটা পোস্ট করেছে। দেখলাম, রসবোধ আছে। সুব্রত এমনিতেই খুব চোখা চোখা কমেন্ট করে। কিন্তু এটা ফাটিয়ে দিয়েছে।
করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায় বলিউড সেলিব্রিটিরা :
১. অক্ষয়কুমার ২৫ কোটি রুপি দিয়েছেন।
২. বরুণ ধাওয়ান ৫৫ লাখ রুপি দিয়েছেন।
৩. কার্ত্তিক আরিয়ান ১ কোটি রুপি দিয়েছেন।
৪. শিল্পা শেঠি ২১ লাখ রুপি দিয়েছেন।
৫. অনুষ্কা শর্মা ৩ কোটি রুপি দিয়েছেন।
৬. সলমন খান ২৫ হাজার দিন মজুরের দায়িত্ব নিয়েছেন।
৭. শাহরুখ খান ৫০ হাজার পিপিই দিয়েছেন।
করোনা যুদ্ধ মোকাবিলায় আমাদের সেলিব্রিটিরা :
১. শাকিব খান ভক্তদের সচেতন থাকতে বলেছেন।
২. জয়া আহসান সবাইকে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
৩. নুসরত ফারিয়া বৈশাখী পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।
৪. টয়া শুটিং সেটের উত্তেজনা মিস করছেন।
৫. পূর্ণিমা করোনার পড় সব বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবেন।
৬. নিপুণ করোনা রোগীদের টেস্ট করানোর জন্য ডাক্তারদের আহ্বান জানিয়েছেন।
বেলা ১১.২৪
আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সবে ঘুমটা ভাঙল। দেখলাম বেড সাইড টেবিলে রাখা চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। খুব টায়ার্ড ছিলাম আসলে। গত কয়েকদিন ধরে একটু বেশিই কায়িক শ্রম হয়েছে বোধহয়। অনেক ঘুম জমেছিল। এখন একটু ঝরঝরে লাগছে। কিন্তু ঘর থেকে বেরতে ইচ্ছে করছে না ।
এই ঘুমে দুটো স্বপ্ন দেখেছি।
প্রথম স্বপ্নটা দেখলাম ফেসবুকে একটা পোস্টার যাতে গাঢ় নীলের ওপরে হলুদ দিয়ে লেখা, ‘প্রয়াত হলেন জ্যোতি বসু’। এমনভাবে লেখা যাতে চারটে শব্দ পোস্টারের চার কোনায় রয়েছে। দেখে প্রথমেই মনে হল, আরে! এ তো পোস্টারেও সোশ্যাল ডিস্টান্সিং হচ্ছে ! তারপরেই হইহই কাণ্ড। রইরই ব্যাপার। শুনলাম পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বলা হচ্ছে, ওঁর মরদেহ নিয়ে মিছিল শুরু হবে। কিন্তু মিছিলে একে অপরের সঙ্গে যেন অন্তত এক মিটার করে দূরত্ব থাকে।
তারপরেই জাম্পকাট করে চলে গেলাম নরেন্দ্রপুরের স্টেডিয়ামে। সেখানে তখন অনেক লোক। চমৎকৃত হয়ে শুনলাম, বিলেতে বাতিল হওয়া উইম্বল্ডন নরেন্দ্রপুরের স্টেডিয়ামে হচ্ছে। বিশাল স্টেডিয়ামে পরপর কোর্ট। তাতে সব বড় বড় তারকারা নকিং করছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, কিছু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারও আছে সেখানে। আমাকে আবার প্যাট ক্যাশ আর মাইকেল বিভানকে দিয়ে কলাম লেখাতে হবে। কিন্তু তাদের খুঁজেই পাচ্ছি না। ওই বিশাল স্টেডিয়ামে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছি আর একে-ওকে জিজ্ঞেস করছি– দাদা, প্যাট ক্যাশকে দেখেছেন? মাইকেল বিভানকে দেখেছেন? কেউ বলছে, ‘ওই তো ওইদিকটায় ছিল’। ঠিক তখনই দেখলাম, উল্টোদিক থেকে ফ্লুরোসেন্ট গ্রিন রঙের একটা ছোট্ট শর্টস আর একটা ভেস্ট পরে কপাটবক্ষ ম্যাথু হেডেন হেঁটে আসছে। আমাকে দেখে বলল, ‘বিভানের শরীরটা খারাপ। হোটেলে ফিরে গেছে। আজকের লেখাটা আমি লিখে দিই?’
আমি সভয়ে বললাম, না-না ম্যাথু নয়। ম্যাথু নয়।কেস খেয়ে যাব।
হেডেন বলল, ‘ধুর বোকা, আমি কি স্যামুয়েল? আমি তো হেডেন।’
দুপুর ১২.৫৯
অসময়ে দীর্ঘ সময় ঘুমোনর পর বিভিন্ন রকমের উপলব্ধি হয়। বিভিন্ন প্রশ্নও জাগে মনে।
উপলব্ধি নম্বর ১. মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হল এসি আর কমোড। ইন হুইচএভার অর্ডার। এসি ঘর থেকে বেরিয়ে কমোডে গিয়ে বসাটা বেটার নাকি কমোড থেকে ঘামতে ঘামতে উঠে এসি ঘরে ঢোকা বলতে পারব না। সবচেয়ে ভাল কম্বো এসি ওয়াশরুমে কমোড। কিন্তু সেসব বোধহয় আমাদের জীবনে হবে না।
বেশ কিছু বছর আগে সিঙ্গাপুর সরকারের আমন্ত্রণে গিয়ে মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেলের একটা কন্ডাক্টেড টুরে গিয়েছিলাম। অসাধারণ হোটেল। কত স্টার কে জানে! শাহরুখ খান যেখানে এসে ওঠেন সেই সুইটটি ঘুরিয়ে দেখানো হল। সবচেয়ে উৎসাহ নিয়ে দেখানো হল ওয়াশরুমটা। পেল্লাই সেই ঘরের এক পাশে মহার্ঘ কমোড। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সেন্সরের চাপে ঢাকনা উঠে যায়। আর কমোড পটি করতে ডাকে।
উপলব্ধি নম্বর ২. আমার বোধহয় খুব একটা হিউম্যান ইন্টারঅ্যাকশন না হলেও চলে। কাজের জন্য হিউম্যান ইন্টারঅ্যাকশন আমার অপছন্দ নয়। কিন্তু ক্যাকোফনি নিতে পারি না। চারদিকে একটু শান্ত পরিবেশ প্রয়োজন হয়।
প্রশ্ন ১ : লকডাউনের পর লোকজনকে দেখে চিনতে পারব তো? পার্লার বন্ধ। সেলুনে তালা। যারা হেয়ার ডাই করাতেন এবং চুল দাড়িতে রং লাগিয়ে খোকা-খুকি সাজতেন, তাঁদের তো আসল রং আর বয়স বেরিয়ে পড়বে! সে তো খুব কেলেঙ্কারি। কী হবে? দাড়ি কামিয়ে ফেলবেন? মাথা নেড়া করে ফেলবেন?
প্রশ্ন ২ : পৃথিবীতে কি এমন কোনও দেশ আছে যেখানে এখনও করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটেনি?
দুপুর ১.৩১
গত দু’দিন ধরে ঘড়ি পরা শুরু করেছি আবার। এবং সেই ফিটনেস ট্র্যাকার সবজান্তা পাকা ঘড়ি বলছে, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় তোমার মুভ রিং খুব একটা নড়াচড়া করেনি। আজ মেকআপ করার চেষ্টা করো।’ হাঃ! মেকআপ না ঘোড়ার ডিম। বয়ে গিয়েছে মুভ করতে। লকডাউনে বেশি মুভমেন্ট বারণ এটা যন্ত্র জানে না। তাই মেলা ফ্যাচফ্যাচ করছে। এইজন্যই মানুষ যন্ত্রের চালক হয়।
বিকেল ৪.১৫
মুখ্যমন্ত্রী আজ রেশন দোকান থেকে দোকান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাতে গোছা গোছা সবুজ মেডিকেল মাস্ক। অকাতরে বিলি করছেন। আজ নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে উনি বলেছেন, সারা দেশের মধ্যে কোভিডের ট্রিটমেন্ট বাংলাতেই সবচেয়ে ভাল হচ্ছে কিন্তু সেটা কেউ বলছে না।
বিকেল ৪.৩৪
অমিতাভ বচ্চন একটা সাদাকালো ছবি টুইট করেছেন। লিখেছেন, ‘১৯৭৫ সালে ১৫ অগস্ট, মিনার্ভায় শোলের প্রিমিয়ারে মা, বাবুজি, জয়া আর বো-টাই পরা আমি। জয়াকে যে কী মিষ্টি লাগছে। ওটা ৩৫ মিমি প্রিন্ট ছিল। ৭০ মিমি স্টিরিও প্রিন্ট কাস্টমসে আটকেছিল। প্রিমিয়ার শেষ হওয়ার পর এসে পৌঁছল। আমরা কয়েকজন থেকে গিয়ে সেটা আবার ভোর ৩টে পর্যন্ত দেখেছিলাম’।
সন্ধ্যা ৬.৪৬
কঠোরভাবে লকডাউন নিশ্চিত করতে কলকাতা এবং হাওড়ায় পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী নামানো হবে। লকডাউন ভাঙলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, কলকাতা এবং হাওড়া দুটি জেলাই রেড জোনে রয়েছে। তাদের যথাসম্ভব দ্রুত অরেঞ্জ জোনে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া বাংলার শ্রমিকদের জন্য ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্প চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ওই প্রকল্পে প্রত্যেক আটক শ্রমিককে এক হাজার টাকা করে দেবে রাজ্য সরকার। যারা ওই প্রকল্পে আবেদন করবে তারা যে বাংলারই শ্রমিক, তা নির্দিষ্ট করতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসককে।
রাত ৮.৩৭
লকডাউন উড়িয়ে কর্ণাটকের কালবুর্গিতে সিদ্ধলিঙ্গেশ্বরা মেলায় হাজার হাজার মানুষ কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে রথ টেনেছে। প্রসঙ্গত, ভারতে প্রথম করোনায় মৃত্যু হয়েছিল এই কালবুর্গিতেই।
এই খবরটা শেয়ার করে ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘স্টুপিডিটি ইজ সেকুলার’। ঠিক লিখেছেন। দশে-দশ।
রাত ৯.৫৮
ফারহা পরভিন বলে একজন টুইট করেছেন, ‘মুসলিমস টেস্ট পজিটিভ ফর পেশেন্স ইন ইন্ডিয়া’।