
লকডাউন ডায়েরি
০৫.০৪.২০২০ । রবিবার
সকাল ৭.৫৪
কাল রাতে ওই লোকটা আর স্বপ্নে আসেনি। তাহলে কি ও অন্য কারও স্বপ্নে গিয়ে দেখা দিল ?
সকাল ৮.০৮
ডায়েরিটা রোজ রাতে বেডসাইড টেবিলে রেখে শুই। ঘুম ভাঙলে টেনে নিয়ে দিনের প্রথম এন্ট্রিটা করি। তারপর সারাদিন লেখা চলতে থাকে। যখন যেমন মনে হয়। আজ মনে হচ্ছিল, আর কতদিন জারি থাকবে এই লেখা? লকডাউন তো চলবে। আরও অন্তত ৯ দিন। ততদিনে আরও কী কী দেখব? কী কী লিখব? ভালবাসার এই কাজটা একঘেয়ে হয়ে যাবে না তো? তারপর ভাবলাম, চারপাশে যা ঘটছে বা ঘটছে না, সেগুলো নথিবদ্ধ করাই এই ডায়েরি লেখার লক্ষ্য। ফলে চলুক যতদিন চালাতে পারি।
যেমন আজ উঠেই মনে পড়ে গেল রাত ৯টায় ৯ মিনিটের জন্য আলোক নির্বাপণ এবং মোমবাতি জ্বালন। দেখা যাক কী হয়। ছাদে উঠে দেখতে হবে কেমন হয় ব্যাপারটা।
দুপুর ১২.১৬
‘প্যারাসাইট’ দেখলাম অবশেষে। অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচারস জানলে বেদম মারবে। কিন্তু অস্কার পাওয়ার মতো মনে হল না। গল্পটা ভাল এগোচ্ছিল। শেষে গিয়ে কেমন একটা ঘেঁটে গেল। বিনা দরকারে দেদার ভায়োলেন্স আমদানি করা হয়েছে। অবশ্য দরকারেও আনা হয়ে থাকতে পারে। আমি বুঝিনি। মোটের ওপর আমার পোষায়নি।
ব্রাত্য একটা লেখা হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছিল। বেসিক্যালি ‘স্পেশাল অপস’এর রিভিউ। একেবারে ধুয়ে দিয়েছে। বলল এমনিই বাড়িতে বসে ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’এর মতো লিখেছে। ওকে জানালাম, ওর বক্তব্যের সঙ্গে ৫০০ পারসেন্ট একমত। চমৎকার লিখেছে। সিরিজটা দেখতে গিয়ে ঠিক যে যে জায়গাগুলো আমার ঝুল লেগেছিল সেগুলো ওরও লেগেছে। এমনকী, বিনয় পাঠকের মতো প্রতিভাশালী অভিনেতার ওই জাঠ পুলিশ অফিসারের রোলে অভিনয় করাটাও।
বেলা ১২.৩০
আজ আর রান্না করতে হয়নি। আগের দিনই করা ছিল। আজ জাস্ট গরম করে দিলাম।
দাঁতের ব্যথা আছে। তবে অনেকটা সহনীয়। হাঁ করে মুখে চামচ ঢোকাতে গেলে এখনও ব্যথা লাগছে। তাই একটা ট্রিক আবিষ্কার করেছি। ঝট করে হাঁ না করে টাইম নিয়ে মুখ খুলে রেখে ১০ পর্যন্ত গুনি। তারপর চামচে করে খাবার ঠুসে দিই।এতে কাজ হচ্ছে। ব্যথাও লাগছে না। খাবার যাচ্ছে ভিতরে। নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ ইনভেনশন। প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জননী।
দুপুর ১.৫৬
অনলাইন সার্ভিস চালু হচ্ছে আবার। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে তেমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ডেলিভারির সময় বাইরে একটা ঝুড়ি, প্যাকেট বা ট্রে-তে আইটেমগুলো রেখে ডেলিভারি বয় বেল বাজিয়ে চলে যাবে। আপনি দরজা খুলে জিনিস নিয়ে নেবেন। কেউ কারও মুখ দেখলেন না। পেমেন্ট নির্ঘাত অনলাইনেই আগাম করে রাখতে হবে। অর্থাৎ, চোরে-কামারে দেখা হবে না। কিন্তু সিঁধকাঠি তৈরি এবং ডেলিভারি হয়ে যাবে।
আরও জল্পনা, ১৪ তারিখের পর নাকি পকেট বেছে বেছে টোটাল লকডাউন হতে পারে। যেমন ওডিশায় ভুবনেশ্বর আর ভদ্রকে হলও ৪৮ ঘণ্টার জন্য।
আজও অফিস যেতে পারলাম না। মুখের ফোলাটা আজও যায়নি। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে একটু। আরও দু-একদিন লাগবে মনে হুচ্ছে।
দুপুর ৩.০২
আবার একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল। দেখলাম, আমাদের পুরনো পাড়া উল্টোডাঙার হাউজিংয়ে গিয়ে দেখছি, পাড়ার মাঝখানে যে টানেলের মতো রাস্তাটা ছিল, বিকেলে খেলার পর আমাদের বন্ধুদের বিশাল গ্রুপ যে রাস্তাটার এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে বেড়াতাম, সেই রাস্তাটা আর নেই। ওটার উপরেও বাড়ি তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমি পাড়ার দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম, এসব কী হচ্ছে? সে বলল, ‘আরে দাদা, এখন তো সব লকডাউন। কেউ রাস্তায় বেরোয় না। আর বেরোবেও না। আর তো রাস্তারই দরকার হবে না। রাস্তা রেখে কী লাভ? তাই পাড়ার কমিটি ঠিক করেছে, রাস্তার উপরেও বাড়ি তুলে দেবে।’
শুনে স্রেফ হাঁ হয়ে গেলাম। ক্লসট্রোফোবিক লাগছিল। দম আটকে আসছিল। পৃথিবীতে আর রাস্তাই থাকবে না? নার্ভাস হয়ে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে গাড়ির চাবি বার করতে গিয়ে পাচ্ছিলাম না। দেখে দারোয়ান হাসতে হাসতে বলল, ‘গাড়ির চাবি দিয়ে কি করবেন? রাস্তা না থাকলে গাড়ি চলবে কোথায়?’
ঘুম ভাঙল। উঠে টলমলে পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলাম, নীচে রাস্তা আছে। গাড়িও আছে।
বিকেল ৪.২৬
ফেসবুকে সৌরভ লিখেছেন, সহ নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে লকডাউনের সময় শহরের একাকী বয়স্ক মানুষদের জন্য দরকারি ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিলেন। আজ সকাল থেকে ২,০০০-এর বেশি ফোন এসেছে মদের হোম ডেলিভারি চেয়ে। শেষ তিন-চারদিন ধরেই আসছে। বাধ্য হয়ে আজ থেকে তাঁরা ওষুধ পৌঁছনোর কাজ বন্ধই করে দিলেন!
ছি! ছি! ছি! এই আমার শহর?
সন্ধ্যা ৬.১২
নেটফ্লিক্সে ‘ফওদা’ দেখতে গিয়ে জোর হোঁচট। পুরোটাই ইজরায়েলি ভাষায়! সাব-টাইটেল পড়তে পড়তে কাঁধ ব্যথা হয়ে যাবে তো। ওই অত্যাচার নেওয়া যাবে না বেশিক্ষণ। সে যতই দুর্ধর্ষ ওয়েব সিরিজ হোক।
রাত ৮.১২
ভারতে মোট আক্রান্ত ৩,২৬০ জন। মৃত ৯৯। সেরে উঠেছেন ২২৯ জন। সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত ৯ লক্ষ ৫ হাজার। মৃত সাড়ে ৬৬ হাজার। সুস্থ হয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ ৫৪ হাজার।
রাত ৮.৫৫
এবার ছাদে যাই।
রাত ৯.১৭
ভয়াবহ! এই হল নাকি দেশের শক্তির প্রকাশ? জনগণের একতার প্রকাশ? এইভাবে বাজি ফাটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে? এই আমাদের দেশ? এই আমার শহর? যেখানে মহামারীর আতঙ্কে, অতিমারির ছায়ায় বাজি পুড়িয়ে উৎকট উল্লাস দেখানো হয়! করোনায় মৃতদের দেহের শেষকৃত্য নিয়ে শহরে যে ইতরামো দেখেছিলাম, এ জিনিস তাকেও ছাপিয়ে গেল।
এ কি সত্যিই নিজের চোখে দেখলাম? অকাল দীপাবলির মতো চারদিকের ব্যালকনিতে প্রদীপের সারি। ছাদে ছাদে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে মানুষ। ঘরের আলো নিভে গিয়েছে আগেই। এই পর্যন্ত তা-ও মেনে নেওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু আকাশে পর পর ফানুস? হাওয়াই বাজি? শব্দবাজি? কোথা থেকে এল? লকডাউনে কি বাজির বাজার খোলা ছিল? নাকি হোম ডেলিভারি দিয়েছে? টুইটারে দেখছি, শুধু কলকাতা নয়। এই ফিচার সারা দেশ জুড়ে।
ছ্যা-ছ্যা-ছ্যা! এই আমার শহর? এই আমার দেশ?
অনেকে দেখছি ফেসবুকে লিখছে, বাঁচার আশায় লোকে মোমবাতি জ্বালিয়েছে। যা সামনে পাচ্ছে তাকেই আঁকড়ে ধরার মানসিকতা থেকে। বেশ। মানলাম। কিন্তু তা বলে শব্দবাজি?!
কোনও পাওয়ার গ্রিডে বিপর্যয় হয়নি। কিন্তু আজ রাতের ওই ৯ মিনিট দেখিয়ে গেল, আসলে কত অন্ধকার আমার দেশ!
স্বপ্ন নিয়ে বেশ বলেছেন জানাদা। সত্যি আমারো মনে হয় স্বপ্নে যেসব চরিত্ররা আনাগোনা করেন তারাও আসলে শিল্পী। আর সেই শিল্পীরা রোজরোজ একজনের চোখে আসেন না, একেকদিন একেকজনের জন্য বরাদ্দ তাদের dates গুলো। কিজানি ওরাও হয়ত প্রোডিউসার দেখে কাজ করেন। দুর্দিনে টাকা সবারই প্রয়োজন তাই ওদের দোষ দিয়েও লাভ কি বলুন।
LikeLike
dhonyobad
LikeLike
শেষ অনুচ্ছেদে শব্দ হয়তো কম,কিন্তু অনেক প্রশ্ন তুলে দিল মনে
LikeLike
proshno toh kom shobderi hoy
LikeLike