
৩১.০৩.২০২০। মঙ্গলবার
সকাল ৮.৪৩
অ্যালার্ম দেওয়া ছিল সাড়ে ৭টায়। স্নুজ করতে করতে উঠলাম একটু আগে। হুড়মুড়িয়ে চা বানালাম। টিভি বলছে, রাজ্যে করোনায় তৃতীয় মৃত্যু হয়েছে হাওড়া হাসপাতালে। আক্রান্ত আরও ৩ জন। দেশে মৃত্যু ৩৩টি। আর সারা দুনিয়ায়? মাত্র এক রাতে আক্রান্ত আরও ৫০ হাজার। ঘুম ভাঙা ইস্তক পিঠে একটা ব্যথা হচ্ছে। নিজেকেই নিজে বললাম, এ নিশ্চয়ই করোনার লক্ষণ নয়। বেঁকেচুরে শোওয়ার ফলে হয়ে থাকবে সম্ভবত।
গরমকালে সল্টলেকের বাড়ির ট্যাঙ্কের জল সকাল থেকেই আগুনের মতো গরম হয়ে থাকে। আজ তো হাতে প্রায় ছ্যাঁকা খেলাম ব্রাশ করে মুখ ধুতে গিয়ে।! নিয়মিত ধুতে–ধুতে এই ক’দিনে হাত–ফাত প্রায় দেবতার মতো ফর্সা হয়ে গিয়েছে। হাতের তালু গোলাপি গোলাপি। ক্যালেন্ডারে দেবদেবীর ছবিতে যেমন দেখা যায়। আর বাস্তবে দেখা যায় বঙ্কুর পায়ের তালুতে।
সকাল ৯.২৮
দ্য লংগেস্ট মার্চ ইন ইন্ডিয়া। হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে বাড়ির পথে। পিঁপড়ের সারির মতো। কাজ নেই। টাকাপয়সা নেই। বাড়িওয়ালা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছে। কারও কারও সম্বল মাত্র এক বোতল জল। তা–ও অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এক ঢোক করে গলায় ঢেলে আবার হন্টন। হাইওয়ে ধরে চলেছে মানুষের অবিশ্রান্ত মিছিল। কেউ পাড়ি দিচ্ছে ৭০০ কিলোমিটার। কেউ ৮০০। কেউ ১৫০ কেউ ২০০ কিলোমিটার। হাঁটছে। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ছে। আবার উঠছে। আবার হাঁটছে। বলছে, ‘পয়দল পয়দল পঁহছ যায়েঙ্গে।’ বলছে, রাস্তায় কোনও ট্রাক দেখলে হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে বলবে একটু এগিয়ে দিতে। যদি কোনও দয়ালু ড্রাইভার সাহায্য করে। দুশ্চিন্তা হয়। মনে হয়, কী খাবে লোকগুলো? কতদিন বাঁচবে? কতদূর যাবে? সারা দেশ জুড়ে চলছে এই অন্তহীন হিচ–হাইক। স্বেচ্ছাসেবকরা খাবার এগিয়ে দিলে বলছে, ‘আমাদের কাছে খাবার আছে। পিছনে আরও লোক আসছে। ওদের জন্য রেখে দিন।’ দেখে ভক্তি হয়। মাথা নুয়ে আসে হ্যাভ নট্সদের জীবনের স্পিরিট আর পরস্পরের জন্য কামারাদারি দেখে।
রোজ সকালে উঠে ভিডিওগুলো একবার করে দেখি। স্রেফ নিজেকে একটা ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য।
বেলা ১২.০৩
আশিস’দার ফোনে ঘুম ভাঙল। গত দু’দিন ধরে সকালে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কে জানে কেন! আশিস’দা বলল, ‘মনে আছে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর যখন দাঙ্গা শুরু হয়েছে, তখন আমি আর তুই বেলেঘাটার গান্ধীভবনে গিয়েছিলাম জাস্ট একবার বাড়িটা দেখে আসতে?’ মনে আছে। বিলক্ষণ মনে আছে। দু’জনে গিয়ে দেখেছিলাম, সত্যি সত্যিই সেখানে আশ্রয় নিয়েছে দাঙ্গাপীড়িত মানুষ। দারুণ স্টোরি হয়েছিল— ‘বেলেঘাটার গান্ধীভবন এখনও অসহায়ের আশ্রয়’। আশিস’দা বলল, ‘আসলে ওই লোকগুলোকে হাঁটতে দেখে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। তখনও এমন অসহায় ঘরপোড়া মানুষ দলে দলে বেরিয়েছিল আশ্রয়ের খোঁজে।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘এত হৃদয়হীন হতে পারে একটা সরকার?! দেশে লকডাউন ঘোষণা করার আগে এই লোকগুলোকে বাড়ি ফেরানোর একটা ব্যবস্থা কর! সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটা স্পেশাল ট্রেন চালা! তাহলেই তো এই লোকগুলোকে রাস্তায় পড়ে মরতে হতো না।’
বেলা ১২.১৫
বিপ্লবকে ফোন করলাম। বাজারে গিয়েছিল আজ সকালে। পালিয়ে এসেছে! লোকের মাথা লোকে খাচ্ছে। চারদিকে চিল চিৎকার, ঝগড়া, তর্কাতর্কি। বলল, ‘বীভৎস অবস্থা। আমি আর বাজারে যাব না। ভয় লাগছে।’ ঠিকই। নিরাপত্তাহীনতা মানুষের সভ্যতা–ভদ্রতার নির্মোক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে। ঘুম পাড়িয়ে রাখা শয়তান ভিতর থেকে এক লাফে বেরিয়ে আসে। সকলকেই প্রতিপক্ষ মনে হয়। মনে হয়, সকলের টুঁটি টিপে ধরি। সকলকে মেরে নিজে বাঁচি। মনে মনে আওড়াই ‘সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট’ তত্ত্ব। মা মেয়েকে ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে পালায়। বৃদ্ধ বাবার দায়িত্ব অস্বীকার করে পারঙ্গম পুত্র।
দুপুর ১২.৪৩
বাবা–মা’কে খেতে দিলাম। স্রেফ ডাল–ভাত–আলুসেদ্ধ। আজ একটু দেরি হয়ে গেল। তার আগে যাবতীয় মায়া-মমতা ত্যাগ করে ওটস এর বাকি প্যাকেটটা জঞ্জালের ঝুড়িতে বিসর্জন দিলাম। ওটাকে আর জাস্ট নেওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু অন্য কিছু রান্না করতেও আর ইচ্ছে করল না । বোধহয় অলস হয়ে যাচ্ছি। এটা ভাল কথা নয়। আজ ঘর মুছব ভেবেছিলাম। সেটাও করা হল না। ভাল নয়। মোটেই ভাল নয়।
মা বলল, অফিস থেকে ফেরার পথে যদি ব্রিটানিয়া গুড ডে বিস্কুট আনতে পারি। বাবা ওটা খেতে ভালবাসে। আমি তো গুচ্ছের থিন অ্যারারুট মজুত করেছি। কাকতালীয়ভাবে দুটো ব্যাপার মনে পড়ল। এক, আজ বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত মিষ্টির দোকান খোলা। দুই, এক চিকিৎসক বন্ধুর টুইট, ‘ওবেসিটি ইজ আ রিস্ক ফ্যাক্টর ইন কোভিড–১৯।’
দুপুর ১.২৯
টিভি চালাতেও আর ভাল লাগে না। তবু পেশার খাতিরে চালাতেই হয়। সারা পৃথিবীতে মৃত ৩৭ হাজার প্লাস। জানি, রাত ফুরনোর আগে এই সংখ্যাটা ৩৮ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। শুধু ইতালিতেই ১১ হাজারের বেশি! দেখলাম, দিল্লিতে এক ধর্মীয় সমাবেশের জেরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সমাবেশ ফেরত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনাভাইরাসে। তার মধ্যে ৬ জনই তেলেঙ্গানার। জমায়েতের আরও ২৪ জনের দেহে করোনা ধরা পড়েছে। ৭০০ জনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। ৫৬ জনকে এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদের খুঁজে বার করে ঘরে না ভরতে পারলে কিন্তু সরকারের কপালে দুঃখ আছে।
আমেরিকায় ব্যারেল পিছু তেলের দাম নেমে এসেছে ২০ ডলারে। গত ১৮ বছরে সর্বনিম্ন। এই কথাটা কাল এই ডায়েরিতে লিখেছিলাম।
দুপুর ১.৪২
সকালে লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম। ফেসবুক চেক করতে করতে আবার চোখে পড়ল। অন্তরা কাল রাতে ডায়েরি পড়ে ফেসবুকে লিখেছিল, ‘তোমার অসামান্য লেখার একটা গোটা প্যারাগ্রাফে আমার গানটার কথা দেখে মনটা ভরে গেল। কালকের লেখাটা পড়ে যেমন চোখ দুটো ভরে গিয়েছিল… একটাই কথা: ওটা গিটার নয়। উকুলেলে বলে একটি হাওয়াইয়ান ছোট্ট–মিষ্টি যন্ত্র।’ ওকে লিখলাম, ওটা তো রোদ্দূর রায়ও বাজায়। অন্তরা লিখল, ‘এই খেয়েছে! না–না, অনেক দেবতুল্য মিউজিশিয়ানও বাজান।’ বললাম, কিন্তু দ্যাখ, ব্র্যান্ড রি–কলটা ওর সঙ্গেই হল। বিজ্ঞাপনে কাজ করিস তো। তাই তোর ভাষায় বললাম। স্মাইলি–সহ জবাব এল, ‘ঠিকাছে।’
দুপুর ১.৫৫
অগ্নি অভিভূত, আপ্লুত, উত্তেজিত। শচীন তেন্ডুলকার টেক্সট পাঠিয়ে ওর কুশল জানতে চেয়েছে। সহকর্মীর জন্য গর্ব হল। শ্রদ্ধা আরও বাড়ল মানুষ শচীনের প্রতি।
দুপুর ২.৩০
চারদিকের আবহাওয়াটা ক্রমশ আরও শুকনো হয়ে যাচ্ছে। গা–হাত–পা টানছে। ঠোঁট–গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। জল খাওয়া কম হচ্ছে নাকি?
বিকেল ৪.১২
অফিসে পৌঁছে কাজে বসলাম। আসার পথে জিডি মার্কেটে গিয়েছিলাম। জিনিসপত্র অকুলান। দোকানের র্যাকগুলো একের পর এক খালি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর ভরছে না। মাল আসছে না। প্রখর রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত মানুষ। দেখে চমক লাগল, ফুটপাথে আঁকা সাদা গোল দাগের মধ্যে পায়ের চটিজোড়া খুলে লাইন রেখে ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন অনেকে। গুড ডে কেনা হল না। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তবে অফিসে আসার পর ম্যান ফ্রাইডে শত্রুঘ্ন খোঁজ নিয়ে বলল, কাল ওর পাড়া থেকে নিয়ে আসবে। প্যাকেটে ২ টাকা করে বেশি দাম চাইছে। নিক। কী আর করা যাবে! পাওয়া তো যাবে।
বিকেল ৫.৩০
লালবাজারে মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশবাহিনীর মরাল বুস্ট করতে। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে কথা বললেন পুলিশকর্মী এবং অফিসারদের সঙ্গে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা শহরে বেরিয়েছিলেন পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে।
সন্ধ্যা ৬.০০
রাজ্যে একদিনে হোম কোয়ারেন্টিনে গিয়েছেন ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ। কাল ছিল ৫০ হাজারের সামান্য কম। অর্থাৎ, একদিনে সংখ্যাটা বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ! বলছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সরকারি বুলেটিনই। চিন্তা। ঘোর চিন্তা। পাশাপাশিই শুনলাম রাজ্যের প্রথম তিন করোনা–আক্রান্ত ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরছেন। টিভি–তে স্কটল্যান্ড ফেরত হাবরার বাসিন্দা তরুণী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে বললেন, ‘শুনতাম, ডাক্তাররা ভগবান। সেটা নিজের জীবনে দেখলাম। ওঁরা আমাকে সবসময় আগলে রেখেছিলেন। সবসময় সাহস দিয়েছেন। ওঁদের কথা জীবনে ভুলতে পারব না।’ স্বস্তি, স্বস্তি।
রাত ৯.১২
দেশে মৃতের সংখ্যা আপাতত ৩৫ জন। কিন্তু যে আশঙ্কাটা এতদিন ধরে জমছিল, সেটা এইমাত্র বাস্তব রূপ নিতে শুরু করল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হল দেশের অর্থনীতি। কমতে শুরু করল স্বল্পসঞ্চয়ে সুদের হার। পার্সেন্টেজ লিখে লকডাউনের এই ডায়েরিকে আরও ডিপ্রেসিং করছি না। কিন্তু এই মৃত্যুপথযাত্রী অর্থনীতিকে বাঁচাবে কোন ভেন্টিলেটর? কোন কোরামিন?
রাত ৯.২২
টুইটারে অর্ণব লিখেছে, ‘দিস শ্যাল নট পাস’।
Khub ghum kature ami, tobu lekha tar jonno jege thaki. Anno din kichhu hooleo positive kichhu pai, maane kharap laagar modhyeo eta valo laaga niye sesh hoye. Aaj sudhui mon kharap korchhe pore.
LikeLike
Ajo deri holo upload korte, ajo mon kharaper khobor..
LikeLike
সেই ১৯৭৯ সাল থেকে যে অনিন্দ্যকে চিনতাম, সেই স্টাইলিস্ট জানা আজও একইরকম আছে দেখছি। খুব সাবলীল লেখা। মনে থাকার মত করেই লেখা হয়েছে। ভালো থেকো বন্ধু, সুস্থ থেকো।
LikeLike
Tumio bhalo theko, shustho theko bondhu.
LikeLike