
২৯.০৩.২০২০। রবিবার
সকাল ৭.২৬
চোখ খুলতেই কাল রাতে দেখা দিল্লির আনন্দ বিহারের ছবিটা ভেসে এল। গাদা গাদা মানুষ। নাচার। অসহায়। সারা দেশ থেকে যাওয়া মাইগ্র্যান্ট শ্রমিককুল। যাঁরা ভিড় করেছেন বাসের জন্য। আবার অনেকে যানবাহন না পেয়ে বাড়ির পথে হাঁটা লাগিয়েছেন। কে জানে কবে পৌঁছবেন! আদৌ কি পৌঁছবেন? রবিবার দিনটা অফিসে খুবই চাপ থাকে। প্লাস এটা লকডাউনের প্রথম রবিবার। মনে হল, মাইগ্র্যান্ট লেবারদের কপিটা আজ ভাল করে ফলো–আপ করাতে হবে।
ফেসবুকের আরও একটা ভিডিও স্লাইডের মতো ঘুরে ঘুরে আসছে চোখের সামনে। কোনও এক হাইওয়ের হার্ড শোল্ডারের পাশে উবু হয়ে দূরে দূরে বসে আছে নাচার মানুষের দঙ্গল। মুখে কাপড় বাঁধা। স্টেটাস বলছে, ‘দিল্লি থেকে হেঁটে বিহারের পথে রওনা দিয়েছিলেন। তিনদিন পর খেতে পেলেন।’ একেবারে সামনে বসা বয়সে তরুণ মানুষটি মুখে গ্রাস তুলতে তুলতে ঝরঝর করে কাঁদছেন। গ্লাভস–পরা একটি হাত তাঁর মাথায়। এক অবাঙালি স্বেচ্ছাসেবীর সস্নেহে গলা ভেসে আসছে, ‘রো কিঁউ রহে হ্যায়? আপ পঁহছ যায়েঙ্গে। অওর বহৎ দূর জানা হ্যায়। আপ খাইয়ে। রোইয়ে মত।’ তরুণের চোখের জল বাঁধ মানছে না। মুখ থেকে ভাতের দলা পড়ে যাচ্ছে পিচের রাস্তায়। শিথিল হাতে সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে আবার মুখে পুরছেন তিনি। কাঁধের গামছায় মুছে নিচ্ছেন চোখমুখ। দূরাগত ট্রাকের হর্ন শোনা যাচ্ছে।
যতবার ভাবছি, চোখে জল আসছে। এ আমার দেশ? এই–ই আমার দেশ?
সকাল ৮.২০
ভিটামিন বি ম্যাজিক জানে! ঠোঁটের ফুসকুড়ি গায়েব। বিরাট হাঁ করতে পারছি। যাকে বলে মুখব্যাদান করা। এত আনন্দ হল, পাঁচদিন পর শেভ করে ফেললাম। ভেবেছিলাম, যতদিন লকডাউন চলবে দাড়ি কাটব না। চুল কাটানোর প্রশ্ন নেই। কারণ, আমার বাঁধা নরসুন্দর কালী জিডি মার্কেটে তার সদ্যখোলা সেলুনটির ঝাঁপ ফেলে কল্যাণীর বাড়িতে চলে গিয়েছে। আগামী কয়েকমাস সম্ভবত চুল কাটানো হবেও না। এই বয়সে অবশ্য আর আলুলায়িত কেশরাজি হবে না। তবু চুল–গোঁফ–দাড়ি না কাটলে একটা কিম্ভূত ব্যাপার হতো। দরকার নেই বাবা।
কাল রাতে রান্না করলাম। বহু, বহুদিন পর। কী পদ বলে নিজেকে বিপদে ফেলতে চাই না। বিশেষত এই ডায়েরি যখন সকলে দেখছে। বলার যেটা, দিল্লিতে থাকার সময় গান চালিয়ে রান্না করতাম। দেখলাম, এতবছর পরেও স্ট্রেসবাস্টার হিসেবে যুগপৎ গান এবং রান্নার উপযোগিতা একটুও কমেনি।
সকাল ৮.৩৪
বাহ্! আজ সল্টলেকের বাড়িতে কাগজ এসেছে। অনির্বাণ মজুমদার জানাল, বিডন স্ট্রিটে কাগজ পেয়েছে। সুতপাও নাকতলায় পেয়েছে। কিন্তু দমদমের বাসিন্দা সহকর্মী নজরুল পায়নি। টুইটার খুলে দেখলাম, আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা আপাতত ১,২০,০০০। মৃত্যু ২,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবীতে মৃত্যু ৩০,০০০ ছাড়িয়ে গেল। পাকিস্তানে ইতিমধ্যেই করোনা–আক্রান্ত ১,৫০০ জন। মারা গিয়েছেন ১২ জন। ঝপ করে মনে পড়ল, আজ থেকে আইপিএল শুরু হওয়ার কথা ছিল।
বাইরে বেজায় গরম। একটা খরখরে হাওয়া বইছে। খুব ড্রাই ওয়েদার। থেকে থেকেই মনে হচ্ছে, ভিতরটা কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছে। প্রচুর জল খেতে হবে। প্রচুর!
সকাল ৯.২৮
অ্যামাজন প্রাইমে অস্কারজয়ী ছবি ‘প্যারাসাইট’ দিয়েছে বলে নোটিফিকেশন এল। খুবই দেখার ইচ্ছে। কিন্তু দেখবটা কখন? এই বাড়িতে এমনিতেই কাজ বেড়ে গিয়েছে। জামাকাপড় কাচার সঙ্গে যোগ হল রান্না করা, বাসন মাজা এবং ঘর ঝাড়মোছ। বাবা–মা’কে সকালে চা করে দেওয়া আর দুপুরে খাবারটাও দিতে হবে। ফুল গৃহবধূ, গৌরবার্থে ‘হোমমেকার’ হয়ে উঠেছি। প্লাস আজ একবার অফিস যাওয়ার আগে চেতলার বাড়িতে যেতেই হবে। যাওয়ার পথে একবার গড়িয়াহাট স্পেনসার্সে ঢুঁ মারতে হবে। বাচ্চাদের খাবার মাংস ফুরিয়ে এসেছে। এই বাড়ির জন্য গেরস্থালির কয়েকটা আবশ্যক জিনিসও ওই বাড়ি থেকে নেওয়া প্রয়োজন। যা বুঝতে পারছি, আগামী অন্তত দু–মাস এই সল্টলেকই আমার ঠিকানা হতে চলেছে। নাকি তার চেয়েও বেশি?
সকাল ১১.৪৮
গড়িয়াহাট স্পেনসার্সে ঢোকার ধৈর্য হল না। ফলে সটান বাড়িতে। ঢুকতেই ঝাঁপিয়ে এল লবঙ্গ। অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকার পর ছেড়ে দেওয়ার সময় মনে হল ফিকফিক করে হাসছে। বাঁ–পাশের ঠোঁটটা একটু উঠিয়ে। ঠিক দেখলাম? লবঙ্গ কি অসমঞ্জবাবুর কুকুর হয়ে গেল! বঙ্কু কিচেনের মেঝেয় শুয়েছিল। ডাকা সত্ত্বেও এল না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম। উঠে একদৌড়ে কোথায় একটা চলে গেল। অভিমান হয়েছে। টিপিক্যাল বিল্লি একটা! যাক গে। ওটা পরে দেখে নেওয়া যাবে। দৌড়লাম মাংসের খোঁজে চেতলা বাজারে। গিয়ে দেখলাম দিব্যি চিকেন পাওয়া যাচ্ছে। কোনও লাইন–টাইনও নেই। তুলে নিলাম প্রায় তিন কিলো। বলল, ওরা রোজ বসছে। সাপ্লাইও রেগুলার। গোটা তেলাপিয়া মাছ নিয়ে গেলে কেটেও দেবে। মার হাব্বা! আর কী চাই। চুলোয় যাক স্পেনসার্সের লাইন। বেশ কিছুদিন এখন নিশ্চিন্ত।
দুপুর ১২.২৩
মুম্বই থেকে দীপাঞ্জন ফোন করল। কিছুক্ষণ আগেও একবার করেছিল। গাড়ি চালাচ্ছিলাম বলে কথা বলতে পারিনি। বলল, ‘লকডাউন ডায়েরি’ পড়ছে। দারুণ লাগছে। এগুলো শুনলে ভাল লাগার পাশাপাশিই একটু অপ্রতিভ আর লজ্জিত লাগে। কী আর এমন তির মারছি। টেররিস্ট এনকাউন্টারে একদা অভ্যস্ত প্রাক্তন এনএসজি কমান্ডোকে বললাম সাবধানে থাকতে। কী স্পর্ধা আমার!
দুপুর ১২.৪৫
অশোক’দার ফোন। মূলত দু’টি প্রশ্ন— কী কী কপি আছে এবং সকলের বাড়িতে কাগজ পৌঁছচ্ছে কিনা। বললাম, সল্টলেকের বাড়িতে আজ কাগজ পেয়েছি। সহকর্মীরাও অনেকেই পেয়েছে। অশোক’দা বললেন, হকাররা কাগজ দিচ্ছেন। ডিমান্ডও বাড়ছে। বললাম, আমরা সকলেই আসলে এই মুখে মাস্ক–হাতে স্যানিটাইজারের জীবনটায় দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। এই দুটো বর্ম নিয়েই বোধহয় বাকি জীবনটা স্বাভাবিক করার চেষ্টায় কাটিয়ে দিতে হবে। ফোনেও প্রবীণ সম্পাদকের স্মিত হাসিটা দেখতে পেলাম।
দুপুর ১.২৭
ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে অফিসে পৌঁছলাম। চারদিক অন্ধকার। এখনও কেউ এসে পৌঁছয়নি। দিল্লিতে রাজীবের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানলাম আজ ওরা কী কী কপি দেবে। বিভিন্ন অয়্যার সার্ভিস সারা পৃথিবী থেকে করোনা সংক্রান্ত ছবি পাঠাচ্ছে। দেখে চোখ কপালে উঠে যায়! তরুণ চক্রবর্তী ফোন করে বলল, আজ চারটে কপি দেবে। একটা রেল নিয়ে। বাকি তিনটে দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চল সংক্রান্ত। মেশিনের মতো কপি লেখে। ইয়ার্কি করে ওকে বলি, রোজ কপি না লিখলে কি তোমার কনস্টিপেশন হয়? টিভি বলছে, নয়াবাদের প্রৌঢ় এখনও আগের মতোই সঙ্কটজনক। কিন্তু রাজ্যের প্রথম করোনা–আক্রান্ত, পদস্থ আমলার পুত্র সুস্থ হয়ে উঠছেন। সারা পৃথিবীতেই এই ট্রেন্ড। একদিকে নতুন নতুন আক্রান্ত। অন্যদিকে প্রথমদিকে আক্রান্তদের মধ্যে কয়েকজনের সুস্থ হয়ে ওঠা। এ এক অদ্ভুত দাঁড়িপাল্লা। যেখানে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর ভার বেশি। ।
দুপুর ২.০৬
এইমাত্র দিল্লি থেকে রাজীবের হোয়াট্সঅ্যাপ ঢুকল। নারদ–খ্যাত ম্যাথু স্যামুয়েল ‘ডিয়ার দিদি’ সম্বোধন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছেন। আবেদন, কেরলে আটকে–পড়া মাইগ্র্যান্ট লেবারদের (বাংলা অনুবাদ হয়েছে— পরিযায়ী শ্রমিক) যেন বাস পাঠিয়ে বাংলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেই নারদ। সেই ম্যাথু। সেই মমতা।
দুপুর ২.৫৯
ফেসবুকে বেস গিটার হাতে নোরা জোন্স। গত মাসে প্রকাশিত ‘পাস অ্যান্ড বুটস’ অ্যালবামের গান গাইছেন বাড়িতে বসে বসে। উস্কোখুস্কো চুল। একটা কালো টি–শার্ট। গানের সঙ্গে আবেদন, ‘আপনাদের কাছে কয়েকমিনিট সময় থাকলে মঞ্চের উপর থাকা যন্ত্রী এবং নেপথ্যের প্রকৌশলীদের তরফে একটা চিঠি লিখুন। যাঁরা লাইভ অনুষ্ঠানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। আমেরিকার সমস্ত ফ্রিল্যান্স মিউজিশিয়ানরা গভীর দুঃসময়ে। সংসার চালাতে পারছেন না। এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়, তা–ও বোঝা যাচ্ছে না। আপনারা চিঠি লিখে মার্কিন কংগ্রেসকে বলুন, যাতে ওঁদেরও বেকারভাতার আওতাভুক্ত করা হয়। ওঁরাও শ্রম দান করেন।’
বিকেল ৩.৩৩
অফিসে ঢুকে দেবাশিস বলল, বাগুইআটির জোড়ামন্দিরের কাছে একটা কালভার্টের তলায় তিনটে মাছরাঙা দেখেছে।
বিকেল ৫.২৪
সব্যসাচীর কথা শুনে চিন্তা আরও বেড়ে গেল। বলছিল, বালিতে ওদের পাড়ায় রিকশাওয়ালারা আজই ওকে বলেছে, ‘আমরা আর বাঁচব না।’ ঠিকই। এরা আর বাঁচবে না। টোটোর জন্য ঝাড় খেয়েছে সাইকেল রিকশা। আবার টোটো ঝাড় খেয়েছে ওলা–উব্রের জন্য। আর ওলা–উব্র এখন বেকার রাস্তায় লোক নেই বলে। এই পুরো চেনের একেবারে নীচের লোকগুলোর সত্যিই কী হবে এবার? সব্যসাচী বলছিল, ‘এবার এরা স্রেফ না খেতে পেয়ে মরবে। অনেকে একা আত্মহত্যা করবে। অনেকে সপরিবারে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে।’ পাশে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞ ফোটোগ্রাফার শিখর’দা বলল, ‘দেখবে এবার কলকাতার রাস্তাঘাটে ভিখিরি কত বেড়ে যাবে। ছোটবেলায় যুদ্ধের সময় যেমন আমরা দেখতাম।’ শুনতে শুনতে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। মাথা ভোঁ–ভোঁ করছে!
সন্ধ্যা ৭.২৪
আলিপুর কমান্ড হাসপাতালের চিকিৎসকের দেহে করোনা। এই প্রথম রাজ্যে একজন চিকিৎসক আক্রান্ত। দিল্লি থেকে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কী যে শুরু হল!
রাত ৮.১১
রাজ্যে আরও একজন ৬৬ বছরের বৃদ্ধের দেহে মিলেছে করোনাভাইরাস। এই নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২০। সারা দেশে আজই মৃত্যু হল ৬ জনের।
রাত ১০.০০
হাইওয়ের পাশে উবু হয়ে বসা তরুণের ছবিটা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না। মনে পড়লেই মাথা ঝাঁকাচ্ছি। চোখ বন্ধ করছি। কিন্তু ছবিটা যাচ্ছে না। মুখ থেকে ভাতের দলা পড়ে যাচ্ছে পিচের রাস্তায়। শিথিল হাতে সেটাই কুড়িয়ে নিয়ে আবার মুখে পুরছেন তিনি। চোখের জল বাঁধ মানছে না। সেই হাপুস কান্নার জলে ভাত–তরকারি মণ্ড পাকিয়ে যাচ্ছে।
যেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে দেশের অসহায়, বন্দি, নাচার জনতা। আমার জন্মভূমি!
Kichhu ta valo laaga, asomvob utkontha, aar churanto asohai lagchhe lekha gulo pore, tobe raate opekhhya teo thaki apner lekhar.
LikeLike
Dhobyobad, bhalo thakun.
LikeLike
Reply notification aage dekhi ni. Aaj kheyal korlam.
Apnio valo thakun, sabdhane thakun.
LikeLike
Khub rasograhi .
LikeLike
Dhobyobad
LikeLike