
২৫.০৩.২০২০। বুধবার
সকাল ৯.০০
কাগজ এল না। কোনও কাগজই এল না। ছাপা হয়েছে। তা–ও এল না। বাড়িতে ৯টা কাগজ রাখি। একটাও আসেনি। আজ ‘আজকাল’এর জন্মদিন। প্রথম পাতায় করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা প্রতিজ্ঞা–সহ শুভেচ্ছাবার্তা দেওয়া হয়েছিল। কেমন ছাপা হয়েছে বুঝতে পারলাম না। অফিসে গিয়ে দেখতে হবে। পুরো পাড়াটা খাঁ–খাঁ করছে। কোথাও কোনও লোক নেই।
বেলা ১২.৩০
একটু আগে সল্টলেকের বাড়িতে এসেছি বাক্স–প্যাঁটরা নিয়ে। অফিস যাওয়ার আগে তাড়াহুড়োয় লিখছি। সারা শহর সুনসান। সল্টলেক এমনিতেই নিঝুম থাকে। আজ আরও ভুতুড়ে লাগছে। বাড়ির ব্যাপারটা মোটামুটি সামলেছি। আসার আগে জিডি মার্কেটে তাপসের দোকানে গিয়ে অফিসে রাখার জন্য প্রচুর টি–ব্যাগ, বিস্কুট, চানাচুর আর ডায়েট চিড়ের প্যাকেট তুললাম। এমনিতেই সেক্টর ফাইভে খাবার–দাবার বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। এখন তো আরওই যাবে না। মার্কেটে কিছু মনিহারি আর ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ। যাঁরা কেনাকাটা করতে আসছেন, তাঁরা হামলে পড়ে যা পারছেন তুলে নিয়ে যেতে চান। যদিও সেটা হচ্ছে না। জিনিসপত্র দেওয়া হচ্ছে টিপে টিপে। তাপসকে বললাম, তোমার দোকান খোলা থাকবে তো? তাপস হেসে বলল, ‘যতক্ষণ মাল থাকবে!’ ওহ্ বাবা। এটা তো ভাবিনি!
দুপুর ১.৩০
অফিসে টুকটুক করে সহকর্মীরা এসে পৌঁছচ্ছে। প্রচেতদা তো বেশ কিছুদিন ধরেই মাস্ক আর গ্লাভস পরতে শুরু করেছে। আজ দেখলাম, বিপ্লবের পকেটেও ছোট একটা স্যানিটাইজারের শিশি। বলল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেই স্যানিটাইজার বানিয়েছে কীসব দিয়ে। ভালই করেছে। স্পোর্টসের কলিগদের মুখে মুখোশের আড়ালে একরাশ উদ্বেগ। স্বাভাবিক। ২০২০ সালটা খেলার দুনিয়ায় অন্যতম ব্যস্ত হওয়ার কথা ছিল। এখন সব বন্ধ। অলিম্পিকও একবছর পিছিয়ে গিয়েছে। আইপিএল পিছনো অবশ্যম্ভাবী। ট্রেন বন্ধ। প্লেন বন্ধ। আজ রাতে শেষ ডোমেস্টিক উড়ান নামবে কলকাতায়।
দুপুর ১.৪৯
স্টোর থেকে ‘প্রেস’ স্টিকার এনে দিল মন্টু। নীচে নেমে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে সেঁটে এলাম। কতদিনের জন্য কে জানে!
বিকেল ৪.১২
অশোক’দার এডিট মিট সেরে এই বেরোলাম। কাল থেকে কাগজ ছাপা হবে না! কাল থেকে অফিসও বন্ধ! সেন্টারে হকাররা কাগজ তুলতে চাইছেন না। অনেকে বলছেন, কাগজ থেকে ইনফেকশন হবে। অনেক বড় হাউজিং কমপ্লেক্সে কাগজ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সব আনসোল্ড ফিরে আসছে। এই অবস্থায় কাগজ ছেপে লাভ নেই। ‘বর্তমান’ তো আজ প্রথম পাতায় ঘোষণাও করে দিয়েছে। ‘গণশক্তি’ও ছাপবে না বলে নোটিস দিয়েছে। ‘খবর ৩৬৫ দিন’ আগেই ছাপা বন্ধ করেছে। শুনলাম, সংখ্যা ঠিক না হলেও ‘আনন্দবাজার’, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’, ‘এই সময়’ আর ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ ছাপবে। ‘সংবাদ প্রতিদিন’ জানিয়েছে, ‘অফিস কপি’ ছাপবে। ঠিক হল, অশোক’দা একটা বিবৃতি দেবেন কাগজের মুদ্রণ সংস্করণ আপাতত বন্ধ রাখা হচ্ছে বলে। ছাপা না হলেও আজ আমরা আটপাতার কাগজ বানাব। ই–পেপার হিসেবে। মনটা খুঁতখুঁত করছিল। অশোক’দাকে মিটিংয়ে বললাম, অফিস কি খোলা থাকবে? যদি মনে হয় কখনও এসে কাজ করতে পারি? অশোক’দা বললেন, অফিস তো বন্ধ হয়ে যাবে। স্পোর্টসের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে জানালাম, কাগজ ছাপা বন্ধ থাকবে। তবে অনলাইন সংস্করণ চালু থাকবে। সেখানে রোজকার মতো কপি ফাইল করা যেতে পারে। আশা করি, এই বিশ্রি অবস্থাটা তাড়াতাড়ি কাটবে। খুব এনার্জেটিক জবাব এল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা ফাঁকা লাগছে।
বিকেল ৫.১২
প্রিন্স চার্লসের করোনা?! কী কাণ্ড!
সন্ধে ৬.০০
ডামি এল। পেজ প্ল্যানিং করলাম। চারদিকে মন খারাপের ভিড়। সকলে চুপচাপ। জবুথবু। কাল থেকে কাগজ বেরোবে না? যে বিপ্লব হাঁকডাকে গোটা অফিস মাথায় করে রাখে, সে–ও কেমন ঠাণ্ডা মেরে গিয়েছে। এনিওয়ে, কাজে বসি এখন।
রাত ১১.৩০
একাট একটা করে সব আলো বন্ধ হয়ে গেল। গোটা অফিস অন্ধকার। শুধু আমার মাথার উপরের আলোটা জ্বলছে। বাতিঘরের মতো। সহকর্মীরা চলে গিয়েছে। সকলে বলে গেল, ‘আশা করি আবার শিগগির দেখা হবে।’ বললাম, ‘নিশ্চয়ই দেখা হবে। সাবধানে থাকিস। ঠিক থাকিস।’ একটু আগে বিপ্লব এসেছিল। ওকে চিন্তিত লাগছিল। বললাম, কী করবি বাড়িতে? বলল, ‘ঘুমোব। বাগান করব। মোবাইলে পিয়ানো শুনব। আমার সময় ঠিক কেটে যাবে।’ শুনে ভাবলাম, তুই ব্যাটা আজকাল–অন্ত প্রাণ! সারা বছরে একটা ডে–অফও নিস না। যতই স্মার্টগিরি কর, অফিস বন্ধ হলে তোর বিপদ সবচেয়ে বেশি।
রাত ১২.১৫
একটু আগে অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ি এলাম। আসার আগে গোবিন্দর সঙ্গে দেখা হল। ও রিপোর্টার–ফটোগ্রাফারদের গাড়ি অ্যালট করে। বলল, গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে আজ রাতেই। যখন অফিস খুলবে, তখন ফিরবে আবার। রাস্তা থেকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে গত চল্লিশ মাসের ঠিকানার দিকে তাকালাম। নিজে নিজেই বললাম, কিছুদিনের মধ্যেই ফিরছি! কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা তিরতিরে আশঙ্কা বয়েই যাচ্ছিল। যে খাবারদাবার অফিসে স্টক করেছিলাম, বাড়িতে নিয়ে এসেছি। টিভি খুললে সেই করোনা আর করোনা। ভাল লাগছে না। তার মধ্যেই একটা ভাল খবর, গত ৪৮ ঘন্টায় কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে করোনা–আক্রান্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। গ্রাফের কার্ভটা নাকি কমেছে। হলেই ভাল। দেখা যাক। আপাতত হটস্টারে কে কে মেননের ‘স্পেশাল অপ্স’ দেখি।