
২৬.০৩.২০২০। বৃহস্পতিবার
সকাল ৮.০০
খবর ভাল না। কাল রাতে খেয়াল করিনি, দক্ষিণ শহরতলির নয়াবাদে এক বৃদ্ধের শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। আপাতত হাসপাতালে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে। দেখা হচ্ছে, তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশভ্রমণ বা বিদেশ প্রত্যাগত কারও সংস্পর্শে আসার রেকর্ড আছে কিনা। তিনি নাকি পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় কোনও বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে বিদেশ থেকে আসা লোকজনও ছিলেন। সেখান থেকেও সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে। হলে তা–ও বাঁচোয়া। নইলে তো বলতে হবে কমিউনিটি ইনফেকশন শুরু হয়ে গেল!
আজ থেকে তো বাড়িতেই! সকাল থেকে একের পর এক দেশি–বিদেশি নিউজ পোর্টাল পড়ছি আর আতঙ্ক হচ্ছে। ভারতে করোনা–আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ১৩০ কোটি দেশের তুলনায় প্রায় কিছুই নয়। ইতালি, স্পেন আর আমেরিকায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় হাজার জনের মৃত্যু হচ্ছে। মৃতের সংখ্যায় স্পেন আজ ছাড়িয়ে গেল চিনকে। ইতালিতে বয়স্ক মানুষদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না। বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কমবয়সীদের চিকিৎসা করা হবে। মানবসভ্যতা এখানে এসে ঠেকল! যারা মারা যাচ্ছে, তাদের কবরে দেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। বডি ব্যাগে মৃতদেহ পড়ে থাকছে। আর্মি এসে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে গণসৎকারের জন্য। ভাবা যায়! আমাদের এখানে হলে কী হবে?? করোনায় মৃত মানুষের দেহ দাহ করতে যেখানে শববাহকরা অস্বীকার করে, মুখ্যমন্ত্রীকে ঘোষণা করতে হয়, করোনায় আক্রান্ত কেউ মারা গেলে আলাদা শ্মশানে দাহ হবে, সেখানে রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকবে তো! মাটি দেওয়ার বা আগুন দেওয়ার লোক পাওয়া যাবে না! নাহ্, আর ভাবতে পারছি না।
সকাল ১০.১৭
এইমাত্র নীরজ পাণ্ডের ওয়েব সিরিজ ‘স্পেশল অপ্স’ শেষ করলাম। নাটকীয়তা আছে। অভিনয়ও ভাল। কিন্তু কোথাও গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি মনে হল। এরপর কী দেখা যায় ভাবতে ভাবতে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজনের মেনু ঘাঁটছি। দূরে কোথাও একটা কুকুর তারস্বরে ডাকছে। ডেকেই চলেছে। রাত্তিরে নির্জন রাস্তায় যেমন ডাকে। ও কি ভাবছে দিনেরবেলায় রাত নেমে এল! ভাল লাগছে না। একেবারেই ভাল লাগছে না।
বেলা ১১.২৬
ভাল খবর। খুব ভাল খবর। কাগজ বেরোবে কাল। এইমাত্র অশোক’দা ফোন করে জানালেন। বিনা ভূমিকায় বললেন, ‘অফিস চলে এসো। মিটিং করব। কাগজ ছাপা হবে। হকাররা কাগজ নিতে রাজি হয়েছে। কাকে কাকে অফিসে আনাবে, সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রদীপের সঙ্গে কথা বলে নাও। আমি বিপ্লব, প্রচেত, রাজীবের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।’ ব্যাপক লাগল শুনে। দ্রুত স্পোর্টসের সহকর্মী অনির্বাণ মজুমদারকে ফোনে ধরলাম— ‘কাগজ বেরবে কাল। কাদের বাড়িতে গাড়ি পাঠাতে হবে, সেটা ঠিক করে প্রদীপ দাশগুপ্তর সঙ্গে কথা বলে নে। আমি জেলাটা কো–অর্ডিনেট করছি।’ পরের ফোনগুলো জেলাবিভাগের দুই সহকর্মী হেমন্ত জানা আর শ্রাবণ স্রোতকে—‘অফিসে আয়। কাগজ বেরোবে কাল। গাড়ির ব্যাপারটা প্রদীপ’দার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নে।’ ওদের সকলের গলায় স্বস্তি আর উচ্ছ্বাস শুনে ভাল লাগছিল।
দুপুর ১.৪৩
একদৌড়ে অফিসে এসেছি। বাকিরাও সেজেগুজে তৈরি হচ্ছে। করোনা–আতঙ্ক ছাপিয়ে আপাতত বয়ে যাচ্ছে স্বস্তির বাতাস। আবার নিউজরুমে আলো জ্বলছে। এসি চলছে। পাখা ঘুরছে। ডেস্কটপ চালু হচ্ছে। প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ভাল লাগছে।
দুপুর ৩.৩৮
মুখ্যমন্ত্রী আজও বাজারে বাজারে ঘুরছেন। কে যেন বলছিলেন, যুদ্ধের সময় জেনারেলদের ওয়ার রুমে বসে পরিচালনা করতে হয়। ফিল্ডে যেতে নেই। তাঁকে মনে মনে বললাম, এ যুদ্ধ সে যুদ্ধ নয়। এখানে দরকার নিজে দৃষ্টান্ত তৈরির। মমতা সেটাই করছেন। ছবি আঁকেন, জানতাম, কিন্তু পিচের রাস্তায় চক আর ইটের টুকরো দিয়ে তাঁর পার্ফেক্ট সার্কল আঁকার ক্ষমতায় চমৎকৃত লাগছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভূগোলের শিক্ষক সুভাষ’দার কথা মনে পড়ছে। চেয়ারে বসে বসেই ডানহাতে চক নিয়ে একটুও না দেখে পিছনের ব্ল্যাক বোর্ডে অমন নিখঁুত বৃত্ত আঁকা যায় দেখে চোখ টেরিয়ে গিয়েছিল।
বিকেল ৪.৩২
দীর্ঘ এডিট মিটিং শেষ হল জাস্ট। আটপাতার কাগজ ছাপা হবে আজ রাতে। আপাতত আটপাতার কাগজই থাকবে। ‘বর্তমান’ও ছাপবে কাগজ। অশোক’দার সঙ্গে অন্যান্য কাগজের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের কথা হয়েছে। ঠিক হয়েছে করোনার সঙ্গে খবরের কাগজের এই লড়াই জারি থাকবে। প্রিন্টের পাশাপাশি অনলাইনেও কাগজ থাকবে। খবর থাকবে। ভিডিও থাকবে। খবরের কাগজের মাধ্যমে যে সংক্রমণ ছড়ায় না, সেটা বারবার বলা হবে। সেটা অবশ্য আগেই বলা শুরু হয়েছে। কিন্তু আতঙ্ক আর প্রাণের দায় মানুষকে এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে যায় যে, তখন আর যুক্তিবুদ্ধি কাজ করতে চায় না। ঠিকই। মাঝেমধ্যে আমারও তো মনে হচ্ছে, অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই হবে কী করে! পাশের লোকটা সংক্রামিত কিনা, বুঝব কী করে! আর এই রোগের তো কোনও সিম্পটমও নেই ছাই! সাধারণ ফ্লুয়ের মতো। সে অর্থে দেখতে গেলে সাধারণ সর্দি–কাশি তো আমাদের প্রায় সকলেরই থাকে। তবে গত ক’দিন ধরে বাতাসে সিসে নেই। শ্বাসকষ্টও অনেক কম। সেদিন সনৎ একটা এনভায়রনমেন্ট অ্যাপ দেখিয়ে বলছিল, ‘দেখুন, কলকাতার সমস্ত এলাকাই এখন সবুজ দেখাচ্ছে।’
সন্ধে ৬.৪২
একটু আগে ফেসবুকে বঙ্কুর একটা ছবি আপলোড করলাম। ও আমার সবচেয়ে ছোট কন্যা। বঙ্কুকুমারী। যত রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, ও আর লবঙ্গ জেগে থাকে। লবঙ্গ আমার রোডেশিয়ান। বাড়ি ফিরলেই দৌড়ে আসে। তারপর বিছানার উপর উঠে সামনের দুটো পা আমার কাঁধে তুলে দেয়। মিনিটদুয়েক ওকে জড়িয়ে ধরে রাখতে হয়। তারপর পিঠে কয়েকটা চাপড়। ব্যস, শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। খুব ন্যাকা। কিন্তু বড্ড ভাল। আর বঙ্কু? যতক্ষণ বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বেলে বই পড়ি, ও পায়ের কাছে গুটিয়ে থাকে। আলো নেভালেই উঠে আসে বুকের উপর। বেশ অনেকক্ষণ ধরে একমনে টি–শার্ট চিবোয়। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। নড়তে পারি না। বেড়ালের সতর্ক ঘুম তো। পাছে ভেঙে যায়! বেঁকেচুরে শুয়ে থাকি। পরদিন ঘাড়ের ব্যথায় মায়োস্প্যাজ ফোর্টে খেতে হয়।
সন্ধে ৭.৩০
বঙ্কু আমার ফেসবুকের ওয়ালে হইচই ফেলে দিয়েছে! কতজন যে এসে কমেন্ট করছে আর ভালবাসছে। আমি কখনো আমি হয়ে, কখনও বঙ্কু হয়ে জবাব দিচ্ছি।
রাত ৯.৩৮
কাগজের সমস্ত পেজ রিলিজ হল একটু আগে। আরও একটা দিন গেল। এখন বাড়ি ফিরে আজকের জামাকাপড় সার্ফে ভেজাতে হবে। কাল কাচাকাচি।
রাত ১.১৮
বাড়ি ফিরে ভাবছিলাম, করোনা আমাদের শেখাচ্ছে কত মিনিম্যালিস্ট ওয়েতে জীবন কাটানো যায়। বন্ধু অনুত্তমা সেদিন বলছিল, ‘দেখিস, করোনা আমাদের শেখাবে জীবনে কোন জিনিসগুলো উদ্বৃত্ত। আর কোনগুলো আবশ্যক।’ ঠিকই। রিস্টওয়াচ নিয়ে বেজায় ফ্যাসিনেশন ছিল। দেশবিদেশের বিভিন্ন জায়গায় অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে পাগলের মতো ঘড়ি কিনেছি। গাদা গাদা ঘড়ি জমেছে। এখন ব্যাটারি ভরতে হিমসিম খাই। আর ডানহাতে বিভিন্ন ধরনের রিস্টলেট। গুচ্ছের জমে আছে কাবার্ডের ড্রয়ারে। সংক্রমণের আতঙ্কে সমস্ত অ্যাকসেসরিজ পরা ছেড়ে দিয়েছি। ঘড়ি না। আংটি না। রিস্টলেট না। পারলে কোমরের বেল্টটাও ছেড়ে দিতাম। কিন্তু সেটা ঝুঁকির হয়ে যাবে। বিপ্লবকে আজ অফিসে বলছিলাম, দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাজ প্রেস্ড দ্য রিবুট বাটন। এখন সব শাটডাউন হয়ে আবার নতুন করে চালু হবে। কিন্তু হবে তো? লবঙ্গকে আবার আমি জড়িয়ে ধরব তো? বঙ্কু আবার আমার টি–শার্ট চিবোতে চিবোতে ঘুমিয়ে পড়বে তো?