
২৪.০৩.২০২০। মঙ্গলবার
রাত ৮.১৫
আজ সকাল থেকে, আসলে গতকাল থেকে দম ধরে বসেছিলাম। আমার মতোই হাঁ করে বসেছিল গোটা ভারতবর্ষ। আজ রাত ৮টায় কী বলেন নরেন্দ্র মোদি। অবশেষে বললেন— আজ রাত ১২টা থেকে সারা দেশ লকডাউন! আগামী ২১ দিন। এটা অবশ্য হওয়ারই ছিল। গত রবিবার থেকে পশ্চিমবাংলায় লকডাউন ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। থ্যাঙ্ক গড, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কঠোর হাতে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন। ৩০ বছরের পেশাদার জীবন তখনই কানে কানে বলেছিল, এ সবে শুরু। এবার সারা দেশ লেকডাউনে যাবে। যেতেই হবে!
সেই গেল। অফিসের দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখলাম। রাত ৮টা ০৭।
‘আজকাল’এর ক্রীড়াবিভাগে যে কিউবিক্লে বসে এই ডায়েরি লিখছি, সেখানে আমার চেয়ারের ঠিক পিছনে নিউজরুমের সঙ্গে কাচের দেওয়ালের বিভাজিকা। প্রশস্ত কিউবিক্লের দু’পাশে কাচের দেড়ফুটের পার্টিশন। ডানপাশের কাচের ওপারে টিভি চলছে। ঘরের অন্যপ্রান্তে, আমার দৃষ্টিপথের ৭৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে আরেকটা টিভি। দুটোতেই গমগম করে বাজছে মোদির ভাষণ। চারদিক নিঝুম। সহকর্মীরা কাজ থামিয়ে দেখছে। হাঁ করে শুনছে। আচমকা সবকিছু থমকে গিয়েছে। নৈঃশব্দ্য ভাঙল এক সহকর্মীর স্বগতোক্তিতে, ‘এবার খাব কী!’
মনে মনে ভাবলাম, মুণ্ডু গেলে খাবিটা কী? কোভিড–১৯ তো মুণ্ডুটাই রাখবে না। স্রেফ জানে মেরে দেবে! কাকতালীয়ই হবে, তখনই শুনলাম মোদি বললেন, ‘জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়।’
মাথায় টিকটিক করছে কিছু আবশ্যিক চিন্তা। প্রথম, বৃদ্ধ বাবা–মা। দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি ছেড়ে সল্টলেকের এইচবি ব্লকে তাঁদের কাছে চলে আসতে হবে। দ্রুত। পারলে কালই। জিডি মার্কেটে চেনা দোকানদারদের ফোন করে খোঁজ নিতে হবে কোথায় কী পাওয়া যাচ্ছে। কতদিন পাওয়া যাবে। ট্রেন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মসলন্দপুর থেকে রোজ রান্না করতে আসে কমলামাসি। গত ২০ বছর ধরে আসছে। ট্রেন বন্ধ হওয়া থেকেই কমলামাসির আসা বন্ধ। আরও অন্তত ২১ দিন আসতে পারবে না। ঘর মুছতে, বাসন মাজতে আসে বাসন্তী’দি। আসতে পারবে না। সবচেয়ে বড় কথা, রাতে মা–বাবার সঙ্গে থাকে সবিতাদি। সে–ও বা কী করে আসবে! চেতলার বাড়িতে খাবারদাবার কেনা আছে কিছুদিনের জন্য। পোষ্যদের খাবারও নিয়ে এসেছি। মাছ–মাংসটা কতদিন যাবে, সেটা দেখতে হবে। ফোন করতে হবে এখন। প্রচুর ফোন। সবচেয়ে বড় ভরসা, দেখছি, রাজ্যের মতোই কেন্দ্রীয় সরকারের এসেনশিয়াল সার্ভিসের ছাড়ের তালিকাতেও ‘প্রিন্ট মিডিয়া’ আছে।
রাত ৯.৩০
সহকর্মী পীতাম্বর আর মন্টুকে বললাম স্টোর থেকে একটা ‘প্রেস’ স্টিকার আনতে। গাড়িতে স্টিকার লাগাতে কোনওদিন পছন্দ করি না। নিজের ফল্স ভিআইপিহুডের চিৎকৃত ঘোষণা করতে রুচিতে বাধে। তাছাড়াও দেখেছি, স্টিকারটা থাকলে ট্র্যাফিক পুলিশ একটু বেশি কড়াচোখে তাকায়। কিন্তু এখন উপায় নেই। ওটাই পাসপোর্ট। প্লাস রাজ্য সরকারের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড। আজ সকালেই যেটা কাজে লেগেছে। মেডিকায় গিয়েছিলাম। ঠাণ্ডা লাগার ধাত আছে। কমবেশি সারা বছর কাশিতে ভুগি। স্মোকার্স কাফ। দীর্ঘদিন ধূমপানের মাসুল। গত ক’দিন ডান কানের পাশে গলায় একটা ব্যথা হচ্ছে। যা বাজার, ভয় লাগছিল। বাল্যবন্ধু তথা ইএনটি স্পেশালিস্ট চিরজিৎ দত্তকে ফোন করে বললাম। ও বলল, ‘মেডিকায় চলে আয়। আমি সকাল থেকেই হসপিটালে আছি। দেখে দেব।’ গেলাম। ধূ–ধূ রাস্তা। মেডিকার প্রবেশপথে সার সার অটোম্যাটিক বেসিন। স্যানিটাইজার। ঢোকার মুখে থার্মাল স্ক্রিনিং। বেশ আশ্বস্ত লাগল। আরও আশ্বস্ত হলাম, যখন চিরজিৎ দেখেটেখে বলল, ‘কান–নাক–গলায় কোনও সমস্যা নেই। গলায় অবশ্য একটু কনজেশন আছে। বিড়িটা ছেড়ে দে এবার। ব্যথাটা দাঁত থেকে হয়ে থাকতে পারে। চেনা কোনও ডেন্টিস্টের সঙ্গে একবার কথা বলে নিস।’ ফেরার পথে পুলিশ আটকাল। কার্ড দেখানোর পর অবশ্য ছেড়ে দিল। আশপাশের কয়েকটা গাড়ি অবশ্য আরও জেরার মুখে পড়ল। আমি বুঝলাম, ভাগ্যে এই পেশায় আছি!
রাত ১০.০০
মন্টু এসে বলল, স্টিকার আজ পাওয়া যাবে না। সন্ধে ৬টায় স্টোর বন্ধ হয়ে যায়। কাল দেখবে। বেশ, তা–ই সই।
রাত ১০.৩০
স্পোর্টস আর জেলা বিভাগের সহকর্মীরা একে একে বিদায় নিচ্ছে দিনের কাজের শেষে। কাল ওদের বাড়ি থেকে তুলে আনতে হবে। গাড়ির রিকুইজিশন স্লিপগুলো সই করে নিউইয়র্ক টাইমসের সেই ডিজিটাল স্টোরিটা আরও একবার খুললাম। কীভাবে কোভিড–১৯ চিনের ইউহান থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেল। দেখে গায়ে কাঁটা দেয়। গ্রেট রিপোর্টিং! ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার এত ভাল কভারেজ আর চোখে পড়েনি। আগেই ফেসবুকে শেয়ার করেছি। এখন আবার কিছু বন্ধুকে পাঠালাম। প্লাস ওটা আমার নিজের কাছেও পাঠানো বিপদসঙ্কেত। মোটিভেশন কার্ডের মতো। ওটা দেখতে দেখতে আমি করোনা ভাইরাস নিয়ে নিজস্ব ভয় আর সচেতনতাটাকে রিনিউ করি।
রাত ১১.৩০
অশোক’দা ফোন করলেন। বললেন, আজ রাতে আর নামছেন না। কাল দেখা হবে। বললাম, ‘এবার কিন্তু ভয় করছে।’ বহু যুদ্ধের প্রবীণ এবং পোড়খাওয়া সম্পাদক জবাব দিলেন, ‘করুক। এই ভয়টা জরুরি।’
Sundor lekha….likhe amader sobistare janao bhai….
LikeLike
Thank you, bhalo thakun
LikeLike
Darun sir…shes line ta sir osadharon 😍…
LikeLike
কী সুন্দর ! সাজানো, গোছানো ডায়েরি তোমার। সাধারণ ঘটনাগুলোকে শব্দ আর বর্ণনায় এমন অসাধারণ করে তোলার জন্য সৃষ্টিকর্তাকে কুর্ণিশ। পড়ি আর শিখি।
শেষ বাক্যে দূরদর্শী অশোকদার হাতে ট্রফি।
*
“যো ডর গ্যয়া সমঝো বাচ গ্যয়া।”
LikeLike
Dhobyobad. Take good care
LikeLike
I felt, u r talking to me. So nice coverage of immediate thoughts on top of mind post Hon’ble PM’s lockdown anouncement….Superb Sir.
LikeLike
Thanks
LikeLike